দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়ছেন মুশফিক।

দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়ছেন মুশফিক। এমন হাসি তাঁকেই মানায়। 
• বেঙ্গালুরুর সেই ‘দুঃখ’ কি প্রেমাদাসায় মুশফিক ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন?
• মুশফিক প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যবহার করেছেন মস্তিষ্ক।
উইনিং শটের প্রতি ব্যাটসম্যানদের লোভ থাকবেই। আর চার কিংবা ছক্কায় ম্যাচ শেষ করে আসলে তো কথাই নেই! মুশফিকুর রহিম ঠিক এটাই ভেবেছিলেন। কিন্তু সেদিন এই আবেগটুকু সামলে রাখলে কালকের ম্যাচ দেখে অন্তত ‘হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে’ ইচ্ছে হতো না!

শেষ ওভারে দরকার ছিল ১১ রান। প্রথম তিন বল থেকেই এসেছে ৯, এর মধ্যে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বলে মুশফিকের টানা দুই বাউন্ডারি। তখন তাঁর ‘অকালপক্ব’ উল্লাস দেখে অনেকেরই ভ্রু কুঁচকেছে। পরে তো বিস্ময়ে চোয়াল খসে পড়ার দশা! শেষ ৩ বলে ১ রানের দূরত্বে থাকতে মুশফিকের সেই শটের ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনি। মুশফিক নিজেই কি পারবেন?

গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেই ওভারের বোলার হার্দিক পান্ডিয়া পরে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। ভারতের এ পেসারের বিশ্বাস ছিল মুশফিক তাঁকে ছক্কা মারতে পারবেন না! আর মুশফিক-মাহমুদউল্লাহর শরীরী ভাষাই বলে দিচ্ছিল চার কিংবা ছক্কার উইনিং শট খুঁজছেন তাঁরা। বাজিতে হেরে যান মুশফিক, হারে বাংলাদেশ। মানুষ সব হার মনে রাখে না, কিন্তু ওই হার ভোলা যায় না।

মুশফিক নিজেও কি ভুলতে পেরেছেন? কালকের ম্যাচ দেখে থাকলে যে কেউই বলবেন—‘না’। দুই বছর আগের সেই ‘অকালপক্ব’ উদ্‌যাপন, ফুলটস বলে সেই অপরিণামদর্শী স্লগ সুইপ—মুশফিক এসবই তুলে রেখেছিলেন হৃদয়ের নীল ক্যানভাসে। যেখানে বেদনা জমা থাকে। মোক্ষম সময়ে উইলোকে তুলি বানিয়ে মুছবেন বলে!

তো, বেঙ্গালুরুর সেই ‘দুঃখ’ মুশফিক কি প্রেমাদাসায়  ভুলিয়ে দিতে পেরেছেন?

দুটি আলাদা ম্যাচ। মহিমাও আলাদা। তাই অনেকে বলবেন ‘না’। তর্কে যাব না। অন্তত এটুকু তো স্বীকার করবেন, মুশফিক ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আর তাই দুই বছর আগের সেই ‘দুঃখ’কে এখন মনে হয় সেই আপ্তবাক্যটির উপলক্ষ, ‘পরিণত হতে হলে পুড়তে হয়।’

‘মরমের আগুন দ্বিগুণ’ নিয়ে মুশফিক পুড়েছেন তো বটেই। মাথায় সেই শটের ‘সাত নদী হার কলঙ্ক’ নিয়ে কাল রাতে তিনি এ কী দেখালেন!

নাগিন নাচ? নাহ্‌, ওটা তো সেই কলঙ্ক মোচনের ভাষা। কিন্তু তার আগে? ৩৫ বলে অপরাজিত ৭২ রানের ইনিংসটা? এ যেন সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘রসগোল্লা’! মুখে দিলেই এক অনির্বচনীয় অনুভূতি।

ইনিংসটা চোখের দেখাতেও অনুভূতিটা একই। উইকেটে এসেছিলেন দশম ওভারে। প্রথম বলেই সিঙ্গেল। স্ট্রাইক ফিরে পেলেন পরের ওভারে। প্রথম বাউন্ডারিটা ‘রিভার্স সুইপ’। পরের ওভারে শেষ দুই বলে ছক্কা ও বাউন্ডারি। এর মধ্যে ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্ট দিয়ে মারা ছক্কার মহিমা আমাদের কাছে হয়তো এ রকম—২০০৩ বিশ্বকাপে শোয়েব আখতারকে শচীন টেন্ডুলকার প্রায় একইভাবে ছক্কা মেরেছিলেন। ভারতীয়দের কাছে সেই ছক্কার আমেজ আজও অমলিন।

মুশফিকের ওই ছক্কাটা হয়তো আজ থেকে ১০-১৫ বছর পরেও একই আবেদন ধরে রাখবে আমাদের মনে। নিজের গার্ড থেকে একটু সরে গিয়েছিলেন। পেসার দাসুন শানাকা তা বুঝতে পেরে খাটো লেংথে বল করেছেন ‘ফোর্থ স্টাম্পের’ও বাইরে। মুশফিক করলেন কী, শূন্যে লাফিয়ে বলটাকে তাড়া করে মারলেন! তাঁর ব্যাট থেকে এমন শট এর আগে কেউ দেখেছেন?

বস্তুত, ওই রকম আত্মবিশ্বাসী শটের পর ব্যাটিংয়ে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। আর তাই দুশর ওপর রান তাড়া করতে নেমে নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া ইনিংসে জয় থেকে ৮ বলে ১৬ রানের দূরত্বে ছোটখাটো কামানও দাগানো সম্ভব!

নুয়ান প্রদীপ ইয়র্কার মারতে গিয়ে লাইন-লেংথে গড়বড় করে ফেলেন। বেশ গতিসম্পন্ন ডেলিভারিটা ছিল অফ স্ট্যাম্পের ওপর ফুলটস। সেটা টেনে মিড উইকেটে মারা চাট্টিখানি কথা নয়। আর মারা তো মারা, ওটা আসলে কামান দাগাই! বলটা আকাশছোঁয়া উচ্চতা নিয়ে আছড়ে পড়েছে শ্রীলঙ্কার ড্রেসিংরুমে। পান্ডিয়া কী তা দেখেছেন? পেস বলে ছক্কা মারাটা যে আসলে শক্তি নয়, স্রেফ টাইমিং আর মাঝ ব্যাটে লাগানোর খেলা, সেটা তো তাঁর জানার কথা!

মুশফিক ততক্ষণে খোঁড়াচ্ছেন। আশির দশকের ক্রিকেটপ্রেমীদের কি তাই দেখে গর্ডন গ্রিনিজকে মনে পড়েছে? ১৯৮৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডস টেস্ট জিততে শেষ দিনে ৭৮ ওভারে ৩৪২ রান দরকার ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের। গ্রিনিজ পায়ে চোট নিয়েই খেলেছিলেন অপরাজিত ২১৪ রানের ম্যাচ জেতানো ইনিংস। বলা হতো, গ্রিনিজ খোঁড়ালেই বেশি ভয়ংকর!

টেস্টের সঙ্গে টি-টোয়েন্টির পার্থক্য আকাশ-পাতাল। কিন্তু কাল মুশফিকের খোঁড়ানোর সঙ্গে একটা জায়গায় গ্রিনিজের সেই ইনিংসের মিল রয়েছে। কেউই অক্রিকেটীয় কিংবা আলগা শট খেলেননি। প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যবহার করেছেন মস্তিষ্ককে। এবার আর কোনো ‘অকালপক্ব’ উদ্‌যাপন নয়। শেষ ৩ বলে আবারও সেই ১ রানের মঞ্চে উঠে নয় চার-ছক্কার খোঁজ। এবার ‘পাপমোচন’।

আর তাই পরের বলেই ‘সিঙ্গেল’ নিয়েই মুশফিকের মুখ চিরে বেরিয়ে এসেছে হুংকার। সেটা কি তাঁর বুক চিরে বেরিয়ে আসা দুঃখ লাঘবের ভাষা?

তাহলে নাগিন নাচ? সেটা নিয়েও প্রশ্ন! বলবেন, তিন শর বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাপুষ্ট কারও অমন উদ্‌যাপন মানায় না। বটে! তা, গত মাসে সিলেট শ্রীলঙ্কার গুনাতিলকা যখন মুশফিকদের সামনে ‘নাগিন’ হয়ে গেলেন, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?

মুশফিক কিন্তু আপনার হয়েই সেই ছোবলের জবাব দিলেন। প্রতিদানে দলের দুঃসময়ে সবাইকে পাশে মুশফিকেরা তো চাইতেই পারেন।