দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ ও রুশ-মার্কিন সম্পর্ক
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার ২৫ বছর পর বিশ্ব অপ্রত্যাশিতভাবে দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের মুখোমুখি। এই অবস্থাটি আর যা-ই হোক অবশ্যম্ভাবী ছিল। কোনো পক্ষের জন্যই এই উত্তেজনা আর সামনে বাড়তে দেয়া উচিত হবে না।
স্নায়ুযুদ্ধ চার দশক ধরে চলে আসছিল। বার্লিন থেকেই এর শুরু এবং শেষ পর্যন্ত এর সমাপ্তিও ঘটে বার্লিনেই। ভালো খবর ছিল, মূলত পারমাণবিক অস্ত্র শক্তিকে আগের পরাশক্তিগুলো একটি শৃঙ্খলার মধ্যে রাখায় এই যুদ্ধ তখন ‘ঠাণ্ডাই’ রয়ে গিয়েছিল। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার ইউরোপীয় ও এশীয় মিত্রদের সাথে নিয়ে এই স্নায়ুযুদ্ধের পর বিজয়ী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। এটি সম্ভব হয় টেকসই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক প্রচেষ্টার কারণে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এর সাথে শেষ পর্যন্ত মোকাবেলা করতে পারেনি।
স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হওয়ার সিকি শতাব্দী পরে, আমরা অপ্রত্যাশিতভাবে দ্বিতীয় এক স্নায়ু যুদ্ধের মুখে। এটি আমাদের কাছে ভিন্ন এবং পরিচিত, দুটোই। রাশিয়া এখন আর পরাশক্তি নয় বরং এটি পৃথিবীর সাড়ে ১৪ কোটি মানুষের এমন এক দেশ যে দেশটির অর্থনীতি, তেল ও গ্যাসের মূল্যের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। আর কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ দেশটির এখন সেভাবে নেই যদিও এটি দু’টি প্রধান পারমাণবিক-অস্ত্রসজ্জিত দেশের একটি। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে তার স্থায়ী আসন আছে আর মিত্রদের সহায়তা করা এবং প্রতিবেশী ও শত্রুদের দুর্বল করার জন্য সামরিক, জ্বালানি এবং সাইবার সামর্থ্য ব্যবহার করার ইচ্ছা রয়েছে রাশিয়ার।
এখন সৃষ্ট অবস্থাটি কিন্তু অনিবার্য ছিল। যুগ যুগ ধরে চলা যুদ্ধের অবসানের পর আশা করা হয়েছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে রাশিয়ার একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পকর্ গড়ে উঠবে। সেই সাথে এটিও ব্যাপকভাবে মনে করা হয়েছিল, কমিউনিজম-পরবর্তী রাশিয়া অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের ওপরই বেশি ফোকাস করবে। আর এ ক্ষেত্রে সূচনাটি ভালোই মনে হয়েছিল। সাদ্দাম হোসেন যখন কুয়েত আক্রমণ করে তখন রাশিয়া তার দীর্ঘ সময়ের মিত্র ইরাকের পাশে না দাঁড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছিল।
রাশিয়ার এই শুভেচ্ছা অবশ্য টেকসই হয়নি। কেন এটি হলো, তা অবশ্য কয়েক দশক ধরে ইতিহাসবিদদের মধ্যে বিতর্কের বিষয় হবে। কিছু পর্যবেক্ষক এজন্য পরপর ক্ষমতায় থাকা মার্কিন প্রেসিডেন্টদেরও অভিযুক্ত করেন। এটি করেন এ জন্য যে, তারা রাশিয়ার অর্থনৈতিক সংগ্রামে সহায়তা করেননি। বরং ন্যাটোকে আরো সম্প্রসারণ করা হয়েছে। এটাকে রাশিয়া তার প্রতি সম্ভাব্য বৈরিতা হিসেবে দেখে যা দু’পক্ষের মতভেদকে আরো বাড়িয়ে তোলে।
এটা সত্য যে, ১৯৯০ এর দশকে রুশ অর্থনীতির বেদনাদায়ক রূপান্তরের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি উদার হতে পারত। এটাও স্পষ্ট নয় যে, ন্যাটোর সম্প্রসারণ ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য কতটা প্রয়োজনীয় ছিল। আর সেটি হলে রাশিয়াকে এতে অন্তর্ভুক্ত করা যেত কিনা। বলা হয়, দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধের উত্থানের দায়ভার প্রধানত রাশিয়া এবং এর নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের। তার অনেক পূর্বসূরির মতো, পুতিনও মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থাকে তার দেশের ন্যায্য অংশীদারিত্বপ্রাপ্তি এবং তার শাসনের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবরোধ, দখল ও ক্রিমিয়ায় শাসন সম্প্রসারণে রাশিয়া সশস্ত্রবাহিনী ব্যবহার করেছে। আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে সামরিক শক্তি দিয়ে এভাবে সীমান্ত পরিবর্তিত হতে পারে না। পুতিন পূর্ব ইউক্রেন, জর্জিয়া এবং বলকান অঞ্চলের অংশবিশেষকে অস্থিতিশীল করতে সামরিক বা গোপন উপায় ব্যবহার অব্যাহত রেখেছেন। আর রাশিয়া সিরিয়ায় বিশেষভাবে বাশার আল-আসাদের নৃশংস ও ভয়ঙ্কর শাসন পরিচালনার পক্ষে সেনা মোতায়েন করেছে।
পুতিনের রাশিয়া আরো বৃহত্তর পরিসর পর্যন্ত নিজেকে নিয়ে গেছে। মার্কিন বিশেষ কৌঁসুলি রবার্ট মুলারের কথায়, ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনসহ মার্কিন রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করেছে মস্কো। মার্কিন গোয়েন্দাপ্রধান স্পষ্ট করেছেন যে, তারা নভেম্বরের মাঝামাঝি মধ্যপন্থী কংগ্রেশনাল নির্বাচনেও এ ধরনের আরো হস্তক্ষেপের আশঙ্কা করেন।
ইউক্রেনে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহসহ স্থিতাবস্থা উল্টে দিতে প্রয়োজনীয় সব কিছু করে রাশিয়া নিজেকে যে একটি সংশোধনবাদী দেশে পরিণত করেছে, সেটিকে হয়তো একটি যুক্তিসম্মত প্রতিক্রিয়া বলার চেষ্টা হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপ কমাতে ভোট মেশিন এবং প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বাড়তি কোনো পদক্ষেপ কি গ্রহণ করতে পারত না?
প্রথমত, আমেরিকানদের স্বীকার করতে হবে যে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। কংগ্রেসের অতিরিক্ত নিষেধাজ্ঞা আরোপের অধিকার রয়েছে এবং কংগ্রেস ইতোমধ্যে পাস করার পরও রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপে অস্বীকৃতি জানানো ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি ভুল।
বর্তমান রুশ শাসনবিরোধীদের গ্রেফতার এবং সাংবাদিকদের হত্যার ব্যাপারে মার্কিন সরকারের আওয়াজ সোচ্চার করতে হবে। যে কারণেই হোক না কেন, ট্রাম্প রাশিয়ার ব্যাপারে কঠোর হতে চান না। এ কারণে কংগ্রেস, মিডিয়া, ফাউন্ডেশন এবং অ্যাকাডেমিকদের প্রকাশ্যে পুতিন শাসনের চরিত্র ও দুর্নীতির ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করতে হবে। এ ধরনের তথ্য প্রচার পুতিনের ওপর অভ্যন্তরীণ বিরোধিতার চাপ বৃদ্ধি করতে পারে। এটি তাকে মার্কিন এবং ইউরোপীয় রাজনীতিতে আরো হস্তক্ষেপ থেকেও বিরত রাখতে পারে। সময়ের সাথে সাথে এটি রাশিয়ার মধ্যে আরো দায়িত্বশীল শক্তির উত্থান ঘটাবে।
একই সময়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়ার সম্পর্কের সামান্য যেটুকু অবশিষ্ট রয়েছে সেটাকে শেষ করা উচিত হবে না। এই সম্পর্ক স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের চেয়ে অনেক নিচে নেমে গেছে। যেখানে সুযোগ রয়েছে সেখানে আমেরিকার স্বার্থেই কূটনৈতিক সহযোগিতা বিস্তার করা উচিত। নিষেধাজ্ঞা শিথিল করার বিনিময়ে পূর্ব ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ কমাতে রাজি হতে পারে রাশিয়া। এ ক্ষেত্রে মস্কো নিশ্চিত হতে চাইতে পারে যে, জাতিগত রাশিয়ানরা প্রতিশোধের সম্মুখীন হবে না। অনুরূপভাবে, ক্রেমলিন সামরিক হস্তক্ষেপে এর খরচ বৃদ্ধি হওয়ার কারণে সিরিয়ায় সামরিক দখল বজায় রাখার ব্যাপারে আগ্রহী নাও হতে পারে।
একই সঙ্গে, উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জোরদার করার জন্যও রাশিয়ার সমর্থন প্রয়োজন। এ ছাড়া অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখা এবং একটি নতুন পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা বন্ধ করা, উভয় দেশের স্বার্থেই দরকার। এ জন্য নিয়মিতভাবে কূটনৈতিক বৈঠক, সাংস্কৃতিক ও অ্যাকাডেমিক বিনিময় এবং কংগ্রেস প্রতিনিধিদের রাশিয়া সফরের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সহায়তা হিসেবে নয়, বৃহত্তর স্বার্থে উপায় হিসেবে আমেরিকানরা পুতিনের ক্ষমতায় থাকাকালে রাশিয়ার সাথে সংযমী সম্পর্ক বজায় রাখার পক্ষে। পুতিনের বিদায়ের পর ‘পুতিনবাদ’ ছাড়া ভিন্নভাবে রাশিয়ার চরিত্র ঠিক করার হয়তো অবকাশ আসতে পারে।
রিচার্ড এন হাস যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক পরিষদের সভাপতি। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের (২০০১-২০০৩) পলিসি প্ল্যানিংয়ের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে অনুবাদ মাসুমুর রহমান খলিলী