ভয়শূন্য দেশ খুঁজে চলছেন ভূস্বর্গ কন্যা
কাশ্মীরে পুরো শৈশবটা ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে কেটেছে ভূস্বর্গ কন্যা ভারতের একাডেমি যুব পুরস্কার পাওয়া ভূস্বর্গের কবি নিঘাত সাহিবার। তিনি বলেন, বাবার মুখে দাড়ি ছিল। তাই ভয় হতো, সেনাবাহিনী যদি তাকে জঙ্গী ভেবে ধরে নিয়ে যায়।
কাশ্মীরের মেয়ে বলেই কবিতায় রক্তের স্রোত। উপত্যকায় কেন মৃত্যু উপচে পড়বে, তা তার মাথায় ঢোকে না। অল্পশিক্ষিত এক ব্যবসায়ীর ঘরে জন্মে। ছয় ভাইবোনের সংসার!
কিশোরী বেলায় প্রেমের কবিতা লেখার সময়ে দাদারা বকবে বলে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকতেন। কবিতা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া! সেই মেয়েই এখন তার কবিতার জোরে সাহিত্য উৎসবে ঘুরছেন, পুরস্কার পাচ্ছেন। তার কবিতায় শান্ত, নরম একটি প্রতিবাদ আছে। অন্যরকম।
পেশায় স্কুলশিক্ষক মহিলা কবি নিঘাত সাহিবা বলেন, ’৯১ সালে কুনান, পোশপোরা গ্রামে শতাধিক নারী সেনাবাহিনীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার বিভীষিকাময় অভিঘাত তিনি দেখেছেন। আমি শুধু শান্তির পক্ষে। কাশ্মীরি, দেশহীন ও সীমান্তহীন কবি।
তিনি বলেন, তার শয়নকক্ষের দেয়ালে টাঙানো ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’র ইংরেজি রূপ। মনে মনে রবীন্দ্র কবিতার সেই দেশটিকেই আমি খুঁজে চলেছি।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা
কাশ্মিরে সহিংসতার জেরে মানসিক অসুখের শিকার হাজার হাজার মানুষ
ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের প্রায় অর্ধেক বয়স্ক মানুষ তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আগে থেকেই ছিলেন কিন্তু ২০১৬ সালে সেখানে যে টানা অশান্তি চলেছে তার জেরে মানসিক রোগীর সংখ্যা বেশ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, দীর্ঘ দিন ধরে সামাজিক-রাজনৈতিক অশান্তি, বেকারত্ব, দারিদ্র্য আর অনিশ্চয়তায় ভরা জীবন কাটাতে বাধ্য হয়ে বিপুল কাশ্মিরী ব্যাপক মানসিক চাপের মধ্যে থাকছেন। ফলে স্বাভাবিক হওয়ার সুযোগ আসার আগেই হয়তো আবারো নতুন করে অশান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাদের।
তার ওপরে স্বতঃস্ফূর্ত মতপ্রকাশের জায়গাগুলোও বন্ধ। তাই অনেক সময়ই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে পাথর ছোড়ার মতো আক্রমণাত্মক ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে। ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের প্রধান মনোরোগ চিকিৎসা কেন্দ্র মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং সংলগ্ন ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরো সায়েন্সেসের (ইমহ্যানস) চিকিৎসকেরা জানান, ২০১৬ সালে ওই রাজ্যে টানা রাজনৈতিক অশান্তির পর থেকে চিকিৎসা করাতে আসা মানসিক রোগীর সংখ্যা এক লাফে প্রায়ে ১০ হাজার বেড়ে গেছে।
তারা বলেন, ২০১৬ সালে ৪০ হাজারের কিছু বেশি মানুষের চিকিৎসা হয়েছিল সেখানে, কিন্তু তার পরের বছর সংখ্যাটা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ওই এক বছরে সংখ্যা অনেকই বেড়ে গেলেও কাশ্মিরে ১৯৮৯ সালে সঙ্ঘাত শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে মনোরোগীর সংখ্যা।
মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা: আরশাদ হুসেইন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ১৯৮৯ সালে আমাদের বিভাগে ১৭শ’-এর মতো মানুষের চিকিৎসা হয়েছিল, কিন্তু ৯০-এর দশকের শেষ দিকে সংখ্যা পৌঁছায় বছরে এক লাখেরও বেশি রোগীতে।
এখন মেডিক্যাল কলেজ আর ইমহ্যানস দু’টি কেন্দ্রের বহির্বিভাগে রোজ প্রায় ৪০০ মানুষ চিকিৎসা করাতে আসছেন। তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। রাজনৈতিক অশান্তি, বেকারত্ব, অনিশ্চিত জীবন। এসব কারণও যেমন আছে, তেমনই রয়েছে ভূমিকম্প বা ২০১৪ ভয়াবহ বন্যার মতো ঘটনাও।
একই হাসপাতালের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ডা: ইয়াসির হাসান জানান, ২০১৬ সালের পর থেকে তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই কিন্তু ওই বছরের অশান্তি ছাড়া আরো কিছু কারণ রয়েছে তার পেছনে।
২০১৬ সাল থেকে রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ ওই বছরে একটানা জনজীবন স্তব্ধ হয়ে থাকার ফলে পুরনো রোগীরা চিকিৎসা করাতে আসতে পারেননি। তাই অনেকেরই সমস্যা বেড়ে গেছে কিছুটা। কিন্তু এ ছাড়াও ৩০ বছর ধরে যে লাগাতার অশান্তি আর সঙ্ঘাত চলছেÑ তারও প্রভাব রয়েছে মনোরোগীর সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে।
মেডিক্যাল ত্রাণ সংস্থা মেডসঁ সঁ ফ্রঁতিয়ে বা এমএসএফ ২০১৫ সালে যে সমীক্ষা করেছিল কাশ্মিরের মানুষের মানসিক রোগের অবস্থা সম্পর্কে সেখান থেকেই জানা গেছে কী বিপুল মানুষ মানসিক চাপ, হতাশা, ট্রমার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন কাশ্মির উপত্যকায়, বলছিলেন ডা: ইয়াসির হাসান।
এমএসএফের ওই সমীক্ষা থেকেই জানা গেছে, ১৮ লাখ প্রাপ্তবয়স্ক কাশ্মিরী কোনো না কোনোপর্যায়ের মনোরোগের শিকার। তাদের মধ্যে প্রত্যেককে গড়ে প্রায় আটটি করে ট্রমার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। এমন ঘটনার সাী হতে হয়েছে, যে কারণে তারা চরম মানসিক আঘাত পেয়েছেন।
সঙ্ঘাতপূর্ণ এলাকায় মানসিক রোগের বিষয়ে খ্যাতনামা বিশেষজ্ঞ এবং শ্রীনগরের সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মনোরোগ বিভাগের সাবেক প্রধান ডা: মুস্তাক মার্গুব বিবিসি বাংলাকে বলেন, ২০১৬ সালের ঘটনাক্রমকে আলাদাভাবে দেখলে চলবে না। ১৯৮৯ সাল থেকেই একটানা সঙ্ঘাতপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে কাশ্মিরের মানুষকে। তাদের কেউ যেমন সম্প্রতি পেলেট বা ছররা বন্দুকে দৃষ্টি হারিয়েছেন, তেমনই কোনো শিশু হয়তো চোখের সামনেই ধ্বংস হতে দেখেছে নিজের বাড়ি, মারা যেতে দেখেছে গোটা পরিবারকেই।
এই একটানা সঙ্ঘাতের সাথেই কখনো জুড়েছে ভূমিকম্প বা বন্যা, বেকারত্ব, দারিদ্র্য এসব কারণ। তাই সাধারণভাবে কাশ্মিরের মানুষ ভীষণ স্ট্রেসের মধ্যে থাকেন। ডা: মার্গুবের কথায়, ২০১৬ সালের অশান্তির সময়ে নতুন করে মানসিক চাপের মধ্যে পড়েন তারা। ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার জন্য যেসব মানসিক রোগী হয়তো ধীরে ধীরে সেরে উঠছিলেন, তারাও নতুন করে অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন।
ডা: ইয়াসিন হাসানের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জমতে থাকা মানসিক অশান্তিরই কি বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে ২০১৬ সালে নিরাপত্তাবাহিনীকে ল্য করে কম বয়সী কাশ্মিরীদের একের পর এক পাথর ছোড়ার ঘটনায়। তিনি বলেন, এ রকম একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছান ঠিক হবে না। এ নিয়ে বলা হয়তো রাজনৈতিক বক্তব্য হয়ে যাবে।
তবে এটাও ঠিক, যখন কাউকে স্বাভাবিকভাবে মতপ্রকাশ করতে দেয়া হয় না, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মত বিনিময়ের জায়গাগুলো সঙ্কুচিত হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোর ওপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়, মানুষ বাড়ি থেকে বের হতে পারে না দিনের পর দিন, তখন এটাই স্বাভাবিক যে ুব্ধ প্রতিক্রিয়া হবেই। এটাই মানুষের মনের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।
মানসিক অশান্তিতে থাকতে থাকতে ভারত অধিকৃত কাশ্মিরের একটা বড় সংখ্যক মানুষ স্নায়ু নিয়ন্ত্রক বেনজোডায়োজিপাইন ওষুধ খান নিয়মিত। আরো অনেকে অনিশ্চয়তা কাটাতে আসক্ত হয়ে পড়েছেন মাদকের দিকে।
বিবিসি