মতামত
চীন-জাপানের মধ্যে নতুন কয়লা যুদ্ধ
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কয়লার চাহিদাকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে চীন-জাপানের মধ্যে নতুন ভূরাজনৈতিক বিরোধ শুরু হয়েছে। দু’টি দেশের উচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা আরো কম কার্বন নিঃসরণ হয়, এমন প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই এই নতুন বিরোধের শুরু।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস, সিয়েরা ক্লাব ও কোলসোয়ার্ম যৌথ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হবে কয়লা উৎপাদনের এক নতুন কেন্দ্রস্থল। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ৮৫ ভাগই উৎপন্ন হয় এশিয়ায় যেখানে চীনসহ বিশ্বের শীর্ষ ২০টি কয়লা উৎপাদনকারী দেশের অবস্থান। সেখানে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় চীন সরকার পরিবেশদূষণ কমিয়ে আনতে কয়লা উৎপাদনের ব্যাপারে কড়াকড়ি আরোপ করছে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়েই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ও কম কার্বন নিঃসরণ হয়, এমন কয়লাপ্রযুক্তির ওপর জোর দিচ্ছে।
চীন এই অঞ্চলে তাদের প্রভাব ক্রমেই বাড়াচ্ছে। তাই এশিয়ায় বেইজিংয়ের সবচেয়ে বড় কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী জাপানও তার কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে বাধ্য হচ্ছে। এশিয়ার দুই বৃহৎ শিল্পোন্নত দেশের মধ্যে নতুন যে বিরোধ শুরু হতে যাচ্ছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জ্বালানি খাত, বিশেষ করে কয়লার ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতিই এর প্রমাণ।
চীনের কয়লাবিষয়ক এই পদক্ষেপ মূলত জ্বালানিভিত্তিক বড় বিনিয়োগ নীতির একটি অংশ, যাতে কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য কয়লাশিল্পকে সঙ্কুচিত এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। চীনা জ্বালানি পরিকল্পনাকারীরা বুঝতে পারছেন, সুদূর ভবিষ্যতেও তারা প্রধান জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার একেবারে ছেড়ে দিতে পারবেন না। চীন দেশকে আরো বহু দিন কয়লার ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে হবে। ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের শতকরা প্রায় ৭৩ ভাগই কয়লার ওপর নির্ভর করে।
কয়লার ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর পদক্ষেপের পরও চীন কয়লাখনির পরিবেশ উন্নত করতে ও দক্ষতা বাড়াতে কাজ করছে এবং এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের সুবাদে তারা দেশের বাইরে সেই প্রযুক্তি রফতানিও করছে।
সারা বিশ্বের জ্বালানি প্রকল্পগুলোতে চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং চায়না এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক গত বছর ২৫.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ দিয়েছে। এই অর্থের পরিমাণ এসব প্রকল্পে আন্তর্জাতিক পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ব্যাংকের বিনিয়োগকৃত ২২.৬ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি।
বাজারব্যবস্থার দিক দিয়ে চিন্তা করলে, উচ্চমানের দক্ষতা ও কম কার্বন নিঃসরণ করার প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ হয়ে ওঠার যে পরিকল্পনা বেইজিং নিয়েছে, তা বাস্তবায়নের উপযুক্ত সময় এখনই। ২০ বছরের মধ্যে এশিয়াজুড়েই কয়লার যে চাহিদা তৈরি হবে, তার শীর্ষে থাকবে চীন। সারা বিশ্বেই এ চাহিদা আগামী সাত বছর বাড়তেই থাকবে। প্রায় ৬২টি দেশে চীনা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে প্রায় এক হাজার ৬০০-এর বেশি কয়লাক্ষেত্র খননের অপেক্ষায় আছে, যা চীনকে উচ্চ উৎপাদন ক্ষমতা ও কম কার্বন নিঃসরণ করার প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।
কারণ, নীতিনির্ধারকেরা এখনো কয়লাকেই নবায়নযোগ্য জ্বালানির তুলনায় অধিক সাশ্রয়ী হিসেবে বিবেচনা করেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শিল্পায়ন কয়লার ওপরই নির্ভরশীল থাকবে। প্রায় ৬৩০ মিলিয়ন মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করতে হলে, এই অঞ্চলের চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হবে আরো এক ধাপ উন্নত কয়লাপ্রযুক্তিকেই। আর সে কারণেই কার্বন নিঃসরণ কমানোর বিষয়টি এসব অঞ্চলে সহজেই অনুমোদন পাবে।
একটি বিষয় বেশ স্পষ্ট, এই দেশের সরবরাহ করা প্রযুক্তি ব্যাপক হারে সম্প্র্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে চীনে আঞ্চলিক সরকারের ওপর এর প্রভাবও বাড়বে। ফলে, কয়লাখনি নির্মাণকে কেন্দ্র করে টোকিও ও বেইজিংয়ের মধ্যকার প্রতিযোগিতা মূলত শুরু হওয়ার পথে।
২০০০ সালে জাপানকে পেছনে ফেলে চীন নেতৃস্থানীয় পর্যায়ে আছে এবং এশিয়ায় কয়লাখনির যন্ত্রপাতি রফতানিতে সে প্রথম সারির রফতানিকারক দেশ। চীন বর্তমানে ভারতে সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ এবং ভিয়েতনামের কয়লা প্রকল্পে জাপানের পরই দ্বিতীয় প্রধান বিনিয়োগকারী। বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব কয়লাখনির নির্মাণকাজ শুরু করেছে চীন।
এসব উন্নয়নকার্যক্রম কয়লা প্রকল্পে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের সুবিধাও দিচ্ছে বেইজিংকে। চীন বেশ কয়েক বছর ধরে নিরন্তর গতিতে সবুজায়ন নিয়ে কাজ করছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও কার্বন ধরে রাখার মতো প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। একই সাথে, আরো আগ বাড়িয়ে জাপানের চেয়ে এই অঞ্চলে একসাথে অনেক বেশি পরিমাণে বিনিয়োগ করছে যখন বেশির ভাগ বহুজাতিক ব্যাংক কয়লাখনিতে বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। এর সুফলও ঘরে তুলতে শুরু করেছে চীন। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৭ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে ‘দ্য জাপান ব্যাংক ফর ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন’ যেখানে পাঁচটি অর্থায়ন প্রকল্পে অংশ নিয়েছে, সেখানে ‘এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না’ অর্থায়ন করেছে সাতটি প্রকল্পে।
তবে জাপানও হাত গুটিয়ে বসে নেই। ২০১১ সালে ফুকুশিমায় পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর থেকে টোকিও কয়লার ব্যবহার বাড়িয়ে দিয়েছে এবং পরিবেশবান্ধব কয়লাখনি প্রকল্পের উন্নয়নে কাজ করছে। বর্তমানে জাপানের হাতেই আছে সর্বাধুনিক পরিবেশবান্ধব কয়লা প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে কম কয়লা পুড়িয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। প্রতিযোগিতামূলক এই সুবিধা আদায় করতে- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখতে এবং চীনকে পেছনে ফেলতে এই দক্ষতাকেই পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। জাপানের নেতৃত্বাধীন এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মাধ্যমে টোকিও ৬.১ বিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মাধ্যমে কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সীমান্ত ছুঁয়ে বয়ে চলা মেকং নদীর অববাহিকাজুড়ে কার্যক্রম পরিচালিত হবে এবং এই পরিকল্পনাকে দেখা হচ্ছে এই অঞ্চল নিয়ে চীনা পরিকল্পনার বিকল্প হিসেবে।
শিগগিরই ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘জাপান-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত জ্বালানি অংশীদারিত্ব’ ঘোষণার অপেক্ষায় আছে টোকিও। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে জ্বালানি খাতের দক্ষতা উন্নয়ন এবং স্বল্প কার্বন নিঃসরণ ব্যবস্থা কার্যকর করার এই যৌথ প্রতিশ্রুতি ‘চীন-জাপান’ জ্বালানি প্রতিযোগিতার হিসাব-নিকাশও পাল্টে দিতে পারে। ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের অচলাবস্থার বিপরীতে এই নতুন অংশীদারিত্ব চীনের জ্বালানি কূটনীতির একটি পাল্টা পদক্ষেপ।
এটা সম্ভবত ‘শুরু’। মার্কিন জ্বালানিমন্ত্রী রিক পেরি বারবার বলছেন, কয়লাই হবে ট্রাম্প প্রশাসনের নীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নিশ্চিত করতে চায় এমন দেশগুলোকে নিয়ে ওয়াশিংটন এরই মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক জোট গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সংস্থাগুলোও যুক্ত থাকবে।
লেখক : সানফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক লেখক ও পরামর্শক।
সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট থেকে ভাষান্তর করেছেন