আফগান বাহিনীর নৈতিক পরাজয়

এশিয়া
আফগান বাহিনীর নৈতিক পরাজয়
আফগানিস্তানের কুন্দুজ প্রদেশের হাশিমিয়া মাদরাসায় গত ২ এপ্রিল দেশটির বিমানবাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছে কয়েক ডজন সদ্য কুরআনে হাফেজ হওয়া শিশু-কিশোরসহ অনেক বেসামরিক লোক।

গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ঘোষণা করেছিল আফগানিস্তানের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করে তালেবানকে আলোচনার টেবিলে আনার। জবাবে তালেবান বলেছিল, এমনিক বারাক ওবামার সময়ের মতোও যদি মার্কিন সৈন্য সংখ্যা হয় তবু তারা ভয় পায় না। গত ২১ মার্চ আফগান নববর্ষের নওরোজ উৎসবের দিন থেকেই দেশটিতে নতুন করে আরেকধাপ সহিংসতার শুরু। যা আলোচনার মাধ্যমে আফগান যুদ্ধ সমাপ্তির সম্ভাবনাকে আরো দূরে সরিয়ে দিলো। সোমবারের এই হামলা প্রমাণ করল যে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না এবং উভয় পক্ষই আরো লাশের মিছিল তৈরির পথেই হাঁটবে।

‘ভুল উদাহরণ’
দুর্ভাগ্যবশত আফগান সরকারের পশ্চিমা মিত্ররা একের পর এক ভুল উদাহরণ দিয়ে যাচ্ছে। তারা সবচেয়ে বেশি যে প্রতিক্রিয়াটি দেখায় সেটি হলো অস্বীকার করা এবং নিজেদের কর্মকাণ্ডের সাফাই গাওয়া। ২০১৫ সালের অক্টোবরে এই কুন্দুজেই ফরাসি স্বেচ্চাসেবী সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার (এমএসএফ) পরিচালিত এক হাসপাতালে বোমা হামলা করে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটে বাহিনীর ওই হামলায় নিহত হয় ১৬ বেসামরিক নাগরিক, আহত হয় আরো ৩৭ জন। হতাহতদের মধ্যে ছিল শিশু, ডাক্তার, রোগী ও হাসপাতালের অন্যান্য কর্মী। যুক্তরাষ্ট্র তাদের হামলার কথা স্বীকার করে বলে, হাসপাতালে হামলার ঘটনা ‘ঘটতে পারে’। তবে নিজেদের কাজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলে, তাদের হামলার লক্ষ্য ছিল এমন লোকেরা যারা ন্যাটো বাহিনীর জন্য হুমকি হতে পারে। তালেবান জানায় যে, ওই হাসপাতালে তাদের কোনো যোদ্ধা ছিল না, এমএসএফ তাদের বিবৃতিতে বলে তাদের হাসপাতালটির বিষয়ে জানত মার্কিন বাহিনী।

গত সোমবারের হামলার পর আফগান বাহিনীও ২০১৫ সালে তাদের মার্কিন মিত্ররা যে কৌশল নিয়েছিল সেই পথে হেঁটেছে এবং হামলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ভুল হওয়ার কথা অস্বীকার করেছে। উদাহরণস্বরূপ আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জোর দিয়ে বলেছেন সেখানে কোনো বেসামরিক লোক ছিল না। তার মতে এটি ছিল তালেবানের একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। অথচ প্রায় একই সময়ে প্রাদেশিক সরকারের গভর্নরের মুখপাত্র জানিয়েছেন যে, ওই বিমান হামলায় অন্তত পাঁচ বেসামরিক লোক নিহত ও ৫৫ জন আহত হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, মাদরাসাটির ওপর প্রথমে আফগান বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার থেকে গুলি ও এরপর রকেট হামলা করা হয়েছে। সেখানে তখন এক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছিল ছাত্র, তাদের অভিভাবক ও শিক্ষকেরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মাদরাসা ভবনের বাইরে চলছিল এই অনুষ্ঠান। সেটি ছিল হেফজ সম্পন্ন করা ছাত্রদের পাগড়ি প্রধান ও মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন। সেখানে কয়েকজন তালেবান নেতার উপস্থিত থাকার কথা জানা গেছে, তবে কোনো বৈঠকে অংশ নিতে নয়, তারা ওই মাদরাসার অনুষ্ঠানেই এসেছিলেন।

নিচু দিয়ে উড়ে চলা একটি হেলিকপ্টারের আফগান পাইলটের অবশ্যই এ রকম একটি প্রকাশ্য অনুষ্ঠান দেখে বুঝতে পারার কথা সেখানে কী হচ্ছে। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, অনেক তালেবান কমান্ডার সেখানে উপস্থিত ছিল এবং বেসামরিক জনতার মধ্যে লুকিয়ে তারা বৈঠক করছিল তবু এ রকম জনবহুল এলাকায় হামলা চালানো জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন এবং নির্বিচারে সামরিক শক্তি প্রয়োগ, হয়তো একটি যুদ্ধাপরাধও।

জাতিসঙ্ঘের দাবি অনুযায়ী এখনো মার্কিন বাহিনী ও তাদের মিত্রদের চেয়ে তালেবানের হাতেই বেসামরিক লোকদের হতাহত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। গত জানুয়ারির শেষ দিকে তারা একটি অ্যাম্বুলেন্সে বিস্ফোরক বোঝাই করে কাবুলের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হামলার জন্য যাচ্ছিল; কিন্তু টার্গেটে পৌঁছতে পারেনি তালেবান। সকালের ব্যস্ত সময়ে একটি হাসপাতালের সামনে বিস্ফোরিত হয় অ্যাম্বুলেন্সটি। ওই ঘটনায় নিহত হয় ৯৫ জন, আহত হয়েছে ১৫৮ জন। গত নওরোজ উৎসবের কয়েক দিন পর হেলমান্দ প্রদেশের রাজধানী লাশকারাঘে একদল লোকের ওপর গাড়ি উঠিয়ে দেয় এক ঘাতক। ওই ঘটনায় নিহত হয়েছে অনেক। কাবুল ইউনিভার্সিটির কাছে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় নিহত হয়েছে ২৯ জন, আহত হয়েছে অর্ধশত। শেষোক্ত দু’টি ঘটনায় আইএস জড়িত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই গোষ্ঠীগুলোর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত বাহিনীগুলো এবং তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া আফগান বাহিনীর কাজ অবশ্যই উচ্চমানের হওয়া উচিত। আফগানিস্তানে যেসব দেশের বাহিনী কাজ করে তাদের হামলায় বেসামরিক লোক নিহত হওয়ার ব্যাপারে আরো বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। জেনেভা কনভেনশন মেনে তাদের বেসামরিক লোকদের ওপর হামলা থেকে বিরত থাকা উচিত। এই নিয়মটি চালু না হলে আফগান বাহিনী নৈতিকভাবে জিততে পারবে না এবং যাদের তারা ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের তুলনায় নিজেদের ভালো দাবি করতে পারবে না।