যেসব কারণে ইরান চুক্তি থেকে সরলেন ট্রাম্প

যেসব কারণে ইরান চুক্তি থেকে সরলেন ট্রাম্প
ইরান চুক্তিটি 'ক্ষয়ে ও পচে গেছে' মন্তব্য করে মঙ্গলবার তা থেকে বের হয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০১৫ সালে ভিয়েনায় হওয়া ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য— যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্স। তাতে স্বাক্ষর করেছিল জার্মানিও। 

চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পথে ইরান আর হাঁটবে না। বিনিময়ে ইরানের ওপর আরোপ করা অর্থনৈতিক অবরোধ তুলে নেওয়া হয়। পুনরায় দেশটি তাদের তেল এবং গ্যাস বিশ্ববাজারে বিক্রি করার অনুমতি পায়।

এই চুক্তি হওয়ার পর থেকে জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন একটি পরিদর্শক দল নিয়মিতভাবে ইরান সফর করে। তারা যে প্রতিবেদনগুলো দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে, ইরান তাদের শর্ত মেনে চলছে।

কিন্তু তার পরও নির্বাচনী প্রচারের সময় থেকেই ইরান চুক্তির বিরোধিতা করে আসছেন ট্রাম্প। তাকে ঠেকানোর জন্য তার মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর নেতারা এবং আমেরিকার ভেতরের সমর্থকরাও শেষ দিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন। তবে তারা সফল হননি।

কিন্তু কেন ইরান চুক্তি থেকে সরে আসলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প? বিবিসির এক প্রতিবেদনে খোঁজা হয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর। এতে বলা হয়েছে, সম্ভাব্য তিনটি কারণই ট্রাম্পকে এই চুক্তি থেকে সরতে প্রভাবিত করেছে। এই তিন কারণের একটি হচ্ছে ট্রাম্পের পূর্বসূরি বারাক ওবামার অর্জনগুলোকে নস্যাৎ করা।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্রান্স-প্যাসিফিক বাণিজ্য আলোচনা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন। গত বছরের জুনে তিনি ঘোষণা করেন, জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকানোর প্যারিস চুক্তি থেকেও তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে নিয়ে আসতে চান। বারাক ওবামার সময় অনিবন্ধিত অভিবাসীদের জন্য সুরক্ষাগুলোও তুলে নেন তিনি। আর ওবামার স্বাস্থ্যবীমা বাতিলের চেষ্টা তো আছেই, যদিও তা খুব একটা সফল হয়নি।

এ ছাড়া কিউবার ওপর ভ্রমণ বিধিনিষেধও নতুন করে আরোপ করেন ট্রাম্প। এসবের পর ওবামা-যুগের একমাত্র বড় উত্তরাধিকার হিসেবে টিকে ছিল এই ইরান চুক্তি। আর সেটাতেও শেষ পর্যন্ত হাত দেন ট্রাম্প।

ইরান চুক্তি থেকে সরে আসার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রতি ট্রাম্পের সমর্থনও অন্যতম একটি কারণ— উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুরুর দিকে ট্রাম্প এ চুক্তিকে 'খারাপ' বললেও এটা থেকে বেরিয়ে আসার কথা বলেননি। কিন্তু ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় কট্টর ইসরায়েলি পক্ষের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করার সময় থেকেই ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান বদলাতে থাকে।

প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্প মার্কিন দূতাবাসকে জেরুসালেমে নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দেন। ইরানের সরকারের বিরুদ্ধে তার নিন্দাও চলতে থাকে। এ ক্ষেত্রে কখনো কখনো তিনি নেতানিয়াহুর তুলে ধরা তথ্য-উপাত্ত উদ্ধৃত করেন।

এসব ছাড়াও ট্রাম্পের নতুন সব উপদেষ্টারাও ইরান চুক্তি থেকে তার সরে আসার পেছনে ভূমিকা রেখেছে উল্লেখ করে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রথম বছরেই ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কিন্তু তার তখনকার উপদেষ্টারা এটা না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এইচ আর ম্যাকমাস্টার ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস। এদের মধ্যে প্রথম দু'জন এরই মধ্যে বিদায় নিয়েছেন। তাদের জায়গা নিয়েছেন মাইক পম্পিও ও জন বোল্টন, যাদের মনে করা হয় ইরানের ব্যাপারে কট্টর নীতির সমর্থক। ফলে এখন ট্রাম্প বরাবরই ইরানের ব্যাপারে যে অবিশ্বাস পোষণ করতেন তার উৎসাহী সমর্থকদেরকেই এখন নিজের উপদেষ্টা হিসেবে পেয়েছেন, যা ইরান চুক্তি থেকে তার সরে আসায় ভূমিকা রেখেছে।

এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইরান চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব। ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষরকারী ছয়টি দেশের মধ্যে তিন ইউরোপীয় দেশ চুক্তিটি টিকিয়ে রাখার পক্ষে। এই তিন দেশ হলো— ব্রিটেন, ফ্রান্স ও জার্মানি। ২০১৫ সালের ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা বাকি দুটি দেশ— রাশিয়া ও চীন চুক্তি টিকিয়ে রাখার পক্ষে। কিন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চুক্তি বাতিলের পক্ষে সমর্থন দিয়েছে সৌদি আরব, ইসরায়েল, আরব আমিরাত ও বাহরাইন। ট্রাম্পের চুক্তি বাতিলের বিরোধিতা করেছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ)। ফলে বিশ্ব এখন কার্যত ইরান চুক্তির পক্ষে এবং বিপক্ষে— এই দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।