দুর্গম সীমান্তে ইন্টারনেট

দুর্গম সীমান্তে ইন্টারনেট
বাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে কয়েক দিন পরে খবর পেতাম। খুব চেষ্টা করলে হয়তো সিগন্যাল রুম থেকে পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারতাম, তবে সে কথা সবাই শুনতে পেত। এখন যখনই ইচ্ছা হয়, কুষ্টিয়ায় থাকা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে পারি। এমনকি ভিডিওতে স্ত্রী-সন্তানদের দেখতেও পারি।’ 
বলছিলেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ল্যান্স নায়েক মো. নাসির উদ্দিন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল বান্দরবানের থানচি উপজেলার বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মদক সীমান্তচৌকিতে (বর্ডার আউট পোস্ট বা বিওপি)।

মদক এতটাই দুর্গম যে সেটা মোবাইল ফোনের সব রকম নেটওয়ার্কের বাইরে। ৫৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধীনে মদকের পরে আরও ছয়টি সীমান্তচৌকি রয়েছে। এই সাত সীমান্তচৌকির চারটিতে গত ১৫ ডিসেম্বর চালু হয়েছে উচ্চগতির তারহীন ইন্টারনেট। এসব জায়গায় দায়িত্বরত বিজিবির সদস্যরা আইপি ফোন এবং ওয়াই-ফাই দিয়ে স্মার্টফোনে যোগাযোগ করতে পারছেন পরিবারের সঙ্গে। পাশাপাশি সীমান্তে কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গেই কর্তৃপক্ষকে জানানো যাচ্ছে। দাপ্তরিক কাজেও এসেছে গতি।সরেজমিনে মদক

স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে বড় মধু বা বড় মদক। নৌকায় করে পাথুরে সাঙ্গু নদী দিয়ে থানচি থেকে মদক পৌঁছাতে সময় লাগল সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার বেশি। ঘাট থেকে তাকালে উঁচুতে দেখা যায় ছিমছাম মদক সীমান্তচৌকি। ৩৬৫ ফুট উচ্চতার বিজিবির এই চৌকিতে বেতার যোগাযোগের যে অ্যান্টেনা, সেটা আগেই ছিল। এর মধ্যিখানে একটা সাদা চাকতি, ব্রডব্যান্ড রিসিভার। এই চাকতিই বদলে দিয়েছে মদকে কর্মরত বিজিবির সদস্যদের জীবন।

মদক বিওপির দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন নাফিস ইরতিজা ইসলাম বললেন, ‘এখানে দুইটি আইপি (ইন্টারনেট প্রটোকল) ফোন রয়েছে। এ দুটি ফোন থেকে যেকোনো ফোনে কথা বলা যায়। আছে তারহীন ওয়াই-ফাই রাউটার। যাঁদের স্মার্টফোন আছে, তাঁরা চাইলে ভিডিও কলও করতে পারেন। ঝিঁঝি ডাকা অন্ধকারের এই দুর্গম অঞ্চলে এটা স্বপ্নের মতোই।’

মদক থেকে ফেসবুক ব্যবহার করে ভিডিও কলও করা গেল। ওয়াকিটকি অপারেটর সিগন্যাল ম্যান শামীম শেখ বললেন, ‘আগে কেউ ফোন করলে বেতারযন্ত্রের সামনে এসে মোবাইলের লাউড স্পিকার চালু করতে হতো। সেই কথা দুই তিন জায়গা ঘুরে আমাদের সিগন্যাল রুমে পৌঁছাত। সবাই ফোনের কথা শুনতে পেত। পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কথাও শোনা যেত।’
এই দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেটের সেবা আনার কারিগরি কাজটি করেছেন তরুণ নেটওয়ার্ক প্রকৌশলী ফজলে রাব্বী।

শুরু যেভাবে
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত রক্ষার জন্য ১৯৭২ সালে মদক সীমান্তচৌকি বসানো হয়। ৯৬ কিলোমিটার জুড়ে সীমান্ত ততটা নিরাপদ ছিল না। ফলে ২০১৬ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত আরও আটটি সীমান্তচৌকি স্থাপন করা হয়। দুটি এখন অন্য ব্যাটালিয়নের অধীনে। ৫৭ ব্যাটালিয়নের অধীনে থাকা সাত সীমান্তচৌকি হলো মদক, নাপরাইতং, হেডম্যানপাড়া, ওয়াংরাইপাড়া, সাপাছড়াপাড়া, পানঝিরিপাড়া ও বুলুপাড়া।

প্রতিটি সীমান্তচৌকিই দুর্গম পাহাড়ে। অভ্যন্তরীণ বেতার যোগাযোগের যন্ত্র ছাড়া সেগুলোয় যোগাযোগের আর কোনো ব্যবস্থা ছিল না। স্যাটেলাইট ফোন অত্যন্ত ব্যয়বহুল। ফলে প্রযুক্তির এই যুগেও চিঠিই ছিল জওয়ানদের যোগাযোগের মাধ্যম।

২০১৫ সালে ৫৭ বিজিবি ব্যাটালিয়নে পরিচালক হিসেবে আসেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হুসাইন রেজা। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি আলীকদমে তিনি প্রথম আলোকে বললেন, ‘এখানে এসেই চিন্তা করতে থাকি, কীভাবে যোগাযোগব্যবস্থা চালু করা যায়। মোবাইল ফোন সংযোগদাতাদের কেউই এখানে নেটওয়ার্ক চালু করতে রাজি হয়নি। ৯৬ কিলোমিটারে জনবসতি ২ হাজার ২০০।’

সেনাবাহিনীর সিগন্যালের এক কর্মকর্তার মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের স্কাইনেট টেকনোলজিস নামের একটি বেসরকারি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফজলে রাব্বীর খোঁজ পাওয়া গেল। ফজলে রাব্বী বছর চারেক আগে অ্যালুমিনিয়ামের দাঁড়িপাল্লায় গ্রামীণফোনের মডেম লাগিয়ে বিচ্ছিন্ন কুলিয়ারচর উপজেলায় নিজের বাড়িতে ইন্টারনেট সেবা নিয়ে গিয়ে অনেকের মনোযোগ কেড়েছিলেন। ২০১৪ সালের ৮ আগস্ট ‘অ্যালুমিনিয়ামের পাল্লায় থ্রিজি’ শিরোনামে তাঁকে নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়। এরপরই তিনি স্কাইনেট টেকনোলজিস প্রতিষ্ঠা করে আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দিতে থাকেন।

হুসাইন রেজা ফজলে রাব্বীকে খুঁজে বের করেন। রাব্বী তাঁকে জানান, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে তারহীন ইন্টারনেটের মাধ্যমে আইপি ফোন। হুসাইন রেজা বিষয়টা বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেনকে জানালে তিনি সম্মতি দেন। ২০১৭ সালের মার্চ মাসের কথা সেটা। এরপর শুরু হলো গবেষণা।

পাহাড়ই যখন বাধা
ইন্টারনেট ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রথম বাধাই ছিল অসমতল ভূমি। গত বছরের জুন মাস থেকে ফজলে রাব্বী গুগল আর্থ, রেডিও মোবাইল ইত্যাদি দিয়ে এই সীমান্ত এলাকা নিয়ে জরিপ করেন। এলাকায় চিম্বুক পাহাড়ে বিটিসিএলের শেষ একটা টাওয়ার। ফজলে রাব্বী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এমন একটা উঁচু পাহাড় খুঁজছিলাম, যেখান মাল্টিপয়েন্ট বিটিএস (বেস ট্রান্সসিভার স্টেশন) বা মূল টাওয়ারটা বসানো যায়।’

হুসাইন রেজা জানালেন, গুগল আর্থে যেসব স্থান চিহ্নিত করা হচ্ছিল, বাস্তবে দেখা গেল সেগুলো নেই। আবার চলল জরিপ। ফজলে রাব্বী বলেন, ‘দুই মাস পর মেকোয়াপাড়ায় প্রায় আড়াই হাজার ফুট উচ্চতায় একটি পাহাড়চূড়া খুঁজে পেলাম, যেখানে মূল বিটিএস বসানো যাবে।’

৯ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে তিন-পাবিশিষ্ট টাওয়ার তৈরির কাজ শুরু করলেন ফজলে রাব্বী ও তাঁর দল। ৬০ ফুট উচ্চতার টাওয়ারটি প্রথমে পাহাড়ের পাদদেশে তৈরি করা হলো। এরপর সেটা খুলে ছোট ছোট টুকরা করে নাট-বল্টুসহ পাহাড়ের ওপরে ওঠানো হলো। ১৪ নভেম্বর থেকে শুরু হলো ৫৭ বিজিবি আলীকদমের পয়েন্ট টু পয়েন্ট এবং পয়েন্ট টু মাল্টিপয়েন্ট বিটিএস টাওয়ার বসানোর কাজ। শেষ হলো ২৭ নভেম্বর। ফজলে রাব্বীর সঙ্গে ছিলেন স্কাইনেটের সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার মো. আরমান, সহকারী সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার মো. আল আমিন, টাওয়ার মেকার দুলাল চন্দ্র দাস এবং রেডিও ইনস্টলার মো. জুয়েল মিয়া।

ফজলে রাব্বী বলেন, ‘বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা করি সৌরবিদ্যুৎ দিয়ে। মেকোয়াপাড়ার টাওয়ার নির্মাণ শেষ হলে ১৫ ডিসেম্বর ইন্টারনেট সংযোগ চালু হয়। এই টাওয়ার থেকে ৩৫ কিলোমিটার এলাকায় সংকেত পাঠানো যায়। মদক, হেডম্যানপাড়া, ওয়াংরাইপাড়া ও সাপাছড়াপাড়া-এই চারটি বিওপির বেতার সংকেত আদান-প্রদানের টাওয়ারে রিসিভার অ্যান্টেনা বসিয়ে তারহীন ইন্টারনেট সরবরাহ করা হচ্ছে। শিগগিরই ৫৭ ব্যাটালিয়নের আরও তিনটি বিওপিতে এ রকম ইন্টারনেট সেবা চালু হবে।’

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বাইতুল ইজ্জতের টাওয়ার থেকে বিটিসিএলের ৫ এমবিপিএস ব্যান্ডউইটথ নেওয়া হচ্ছে। এরপর এটি যাচ্ছে চিম্বুক পাহাড়ে থাকা বিটিসিএলের টাওয়ারে। সেখান থেকে আলীকদমের টাওয়ার হয়ে মেকোয়াপাড়ার টাওয়ারে পৌঁছাচ্ছে তারহীন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। এই টাওয়ার থেকে বিওপিগুলোতে সংকেত পাঠানো হচ্ছে।

যোগাযোগ ও সীমান্ত সুরক্ষা বাড়বে
বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের শেষ বিন্দু বুলুপাড়া পর্যন্ত ইন্টারনেট সংযোগ বিস্তৃত হবে শিগগিরই। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. হুসাইন রেজা বললেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তির শক্তিকে ব্যবহার করে সীমান্তের সুরক্ষা আরও বাড়ানো যায়। ইন্টারনেট থাকায় চাইলেই এখন এই দুর্গম পার্বত্য সীমান্তে সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা বসাতে পারি। ফলে যেকোনো জায়গা থেকে সীমান্তে নজরদারি করা যাবে।’

ফজলে রাব্বী বলেন, ‘দেশের দুর্গম এলাকায় ইন্টারনেট নিয়ে যেতে চাই। পাহাড়ে কষ্টসাধ্য এই কাজ করার পর যখন বিজিবির সদস্যদের হাসিমুখ দেখেছি, তখন আমার সব কষ্ট দূর হয়ে গেছে।’