অগ্নিঝরা ১২ মার্চ আজ। ১৯৭১ সালের এইদিনে তীব্র হয়ে উঠেছিল অসহযোগ আন্দোলন।
অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সব ছিল বন্ধ। ঢাকাসহ সারাদেশ ছিল আন্দোলন, বিক্ষোভ আর মিছিল-স্স্নোগানে উত্তাল। বীর বাঙালির তুমুল আন্দোলনে ঔপনিবেশিক শাসক-শোষক গোষ্ঠীর ভিত কেঁপে ওঠে। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাই যেন শুধু বাকি ছিল, সবখানেই চলছিল চূড়ান্ত্ম প্রস্ত্মুতি।
এদিকে ঢাকার ধানম-ির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধুর বাসভবন তখন রূপ নিয়েছে মুক্তিপাগল বাঙালির একমাত্র ঠিকানায়। এখান থেকে আন্দোলনের নানা দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। সকাল গড়িয়ে দুপুর, তারপর বিকেল থেকে রাত যেন ঘুম নেই বাড়িটির। সকাল থেকে রাত অবধি বঙ্গবন্ধু স্থানীয় ও পশ্চিম পাকিস্ত্মানের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন তার ধান-ির বাসভবনে। প্রত্যেককে যার যার এলাকায় গিয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানান তিনি। এদিন বৈঠক হয় জাতীয় লীগ প্রধান আতাউর রহমান খান এবং পাঞ্জাবের কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা পীর সাইফুদ্দিনের সঙ্গে।
জাতীয় শ্রমিক লীগের জরম্নরি সভায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত্ম নেয়া হয়। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় সব ইউনিট ও ইউনিয়নকে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। জাতীয় পরিষদ সদস্য মোহাম্মদ জহির উদ্দিন পাকিস্ত্মান সরকারের দেয়া খেতাব বর্জন করেন। রাওয়ালপিন্ডিতে এক সরকারি ঘোষণায় ২৩ মার্চ পাকিস্ত্মান দিবসের
হনির্ধারিত সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজ, খেতাব বিতরণ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাতিল করা হয়।
অন্যদিকে বগুড়া জেলখানা ভেঙে ২৭ কয়েদি পালিয়ে যান। চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত্ম নেন।
গণঐক্য আন্দোলনের প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, পাকিস্ত্মানকে রক্ষা করার জন্য এখন একটাই পথ খোলা রয়েছে তা হচ্ছে শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে ক্ষমতা হস্ত্মান্ত্মর করা। তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে পরদিনের প্রথম ফ্লাইটে ঢাকা যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, হাতে সময় খুবই কম। আপনি ঢাকা গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন।
লারকানা থেকে লাহোরে যাওয়ার পথে মুলতান বিমানবন্দরে পিপলস পার্টি চেয়ারম্যান জুলফিকার আলি ভুট্টো বলেন, পাকিস্ত্মানের অখ-তা ও সংহতি রক্ষার জন্য আমার দল সবধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। লাহোরে ন্যাপের মহাসচিব সিআর আসলাম এক বিবৃতিতে বলেন, শক্তি প্রয়োগের নীতি অব্যাহত থাকলে পূর্ব পাকিস্ত্মানে বিচ্ছিন্নতার মনোভাব শক্তিশালী হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উচিত অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর চার দফা দাবি মেনে নেয়া। লাহোরের স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিকসহ ছাত্র, শ্রমিক ও পেশাজীবী সংগঠনের নেতারা এক যুক্ত বিবৃতিতে অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্ত্মান্ত্মরের দাবি জানান।
একাত্তরের এইদিনে পটুয়া কামরম্নল হাসানের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত্ম নেয়া হয় শাপলাই হবে জাতীয় ফুল। শুধু শিল্পীরা নন, এদিন আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করেন সরকারি কর্মচারী, সাংবাদিক, সাহিত্যিকসহ সর্বস্ত্মরের জনতা। চারম্ন ও কারম্নশিল্প মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ সৈয়দ শফিকুল হোসেনের নেতৃত্বে শিল্পীরা সিদ্ধান্ত্ম নেন, অসহযোগ আন্দোলন এগিয়ে নিতে তারা মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে স্কেচ, পোস্টার ও ফেস্টুন বিতরণ করবে।
এদিন শিল্পী মূর্তাজা বশির ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত হয় চারম্নশিল্পী সংগ্রাম পরিষদ। পূর্ব-পাকিস্ত্মান সিভিল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন এদিন আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং আন্দোলনের জন্য তাদের একদিনের বেতন দেয়ার সিদ্ধান্ত্ম নেয়। সাংবাদিকরাও এদিন রাস্ত্মায় নেমে আসেন। পূর্ব পাকিস্ত্মান সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতারা সভা করে আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত এবং রাজপথে মিছিল করেন।