মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন: দেশে ফিরে অশ্রুনয়নে মালালা

মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন: দেশে ফিরে অশ্রুনয়নে মালালা
প্রায় ৬ বছর পর জন্মভূমি পাকিস্তানে ফিরে কাঁদলেন মালালা ইউসুফজাই। বললেন, এতগুলো বছর দেশে ফেরার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আর এখন দেশের মাটিতে পা দিয়েও যেন বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিই এটি ঘটেছে। সবকিছুই যেন স্বপ্ন।

তালেবান জঙ্গিদের গুলিতে মারাত্মক আহত হয়ে ২০১২ সালে পাকিস্তান ছাড়েন মালালা। গত বুধবার রাতে বাবা-মা’সহ প্রথমবারের মত দেশে ফেরেন শান্তিতে নোবেল জয়ী এ পাকিস্তানি তরুণী।

এরপরই বৃহস্পতিবার ইসলামাবাদে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এক অনুষ্ঠানে মালালা আবেগজড়িত কণ্ঠে তার দেশে আসার স্বপ্নের কথা বলেন।

সরাসরি টেলিভিশনে প্রচারিত ওই বক্তব্যে মালালা বলেন, “গত ৫ বছর ধরে আমি দেশে আসার স্বপ্ন দেখেছি।”

বাস্পরুদ্ধ কন্ঠে তিনি বলেন, “আজ আমি খুবই আনন্দিত। আমি সাড়ে পাঁচ বছর পর আবার আমার নিজদেশের মাটিতে পা রাখতে পেরেছি।”

কখনো উর্দু আবার কখনো পশতু ভাষায় মালালা বলে চলেন, “আজ আমার জীবনের সব চেয়ে আনন্দের দিন। কারণ, আমি দেশে ফিরে এসেছি। আমি আবার দেশের মাটিতে পা রেখেছি। আমার দেশের জনগণের মাঝে ফিরে এসেছি।”
চোখের পানি মুছতে মুছতে মালালা আবার বলেন, “আমি খুবই খুশী। আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা যে এটি সত্যিই ঘটছে। গত ৫ টি বছর আমি বাড়ি ফেরার স্বপ্ন দেখেছি। লন্ডনে বা নিউ ইয়র্কে যখনই আমি কোনো বিমান বা গাড়িতে চড়েছি, আমি নিজেকে বলতাম যে- কল্পনা কর এটি পাকিস্তান, তুমি ইসলামাবাদের রাস্তায় চলছ, কল্পনা কর এটি করাচি। কিন্তু তা কখনই বাস্তব ছিলনা। আর  এখন আমি সেটিই দেখছি। আমি আজ অনেক খুশি।”

 “ আমার জন্ম ১৯৯৯ সালে, কিন্তু আমি খুব বেশি কাঁদিনি,” একথা বলেই হেসে ওঠেন মালালা। বলেন, “এখন আমার বয়স ২০, কিন্তু এ সময়ের মধ্যেই জীবনে অনেককিছু দেখে ফেলেছি। সোয়াতে বেড়ে উঠেছি, অনেক সুন্দর জায়গা। ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেখানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের উত্থান দেখলাম। এরপর দেখলাম আমাদের সমাজের নারী আর মেয়েরা কত প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে আর কিভাবে এসব বাধার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়।”

“এরপর হামলার শিকার হয়ে আমাকে দেশ ছাড়তে হল, আপনা থেকেই সবকিছু ঘটে গেল। আমার কিছু করার ছিল না। আমার কিছু বলার সুযোগ থাকলে আমি কখনই দেশ ছাড়তাম না। চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচার করে আমার জীবন বাঁচালেন। কিন্তু তারপর আরো ভাল চিকিৎসার জন্য আমাকে বিদেশে যেতে হল। পড়াশুনাও করতে হল সেখানেই। কিন্তু আমি সবসময়ই স্বপ্ন দেখতাম দেশে ফিরব, নির্ভয়ে দেশের মাটিতে হাঁটব, দেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলব। এটি হবে আমার সেই চেনা বাড়ির মত। আগে যেমনটি ছিল।”

পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রজন্মকে বড় সম্পদ উল্লেখ করে মালালা বলেন, “শিশু শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মালালা ফান্ড ইতোমধ্যে এ নিয়ে কাজ করছে। আমরা পাকিস্তানে নারী শিক্ষায় ৬০ লাখ ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছি। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। পাকিস্তানের ভালর জন্য সবাই হাতে হাত রেখে কাজ করবে বলে আমি আশাবাদী। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম যেন শিক্ষার অধিকার পায়। নারীর ক্ষমতায়ন হয়, নারীরা যেন চাকরি করতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, আয় করতে পারে। এরকম ভবিষ্যৎই আমরা দেখতে চাই।”

দেশে ফেরায় মালালাকে স্বাগত জানিয়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাকান আব্বাসি বলেন, “আমি খুবই খুশি যে জাতির মেয়ে ঘরে ফিরেছে। যখন তুমি দেশ ছাড় তখন তোমার বয়স ছিল ১৩ বছর। আজ তুমি দেশের সবচেয়ে খ্যাতনামা নাগরিক। গোটা বিশ্ব তোমাকে সম্মান জানিয়েছে এবং পাকিস্তানও জানাবে। এটি তোমার দেশ, তুমি এখন সাধারণ কোনো মানুষ নও। তোমার নিরাপত্তার দায়িত্ব এখন আমাদের।”

পাকিস্তানের সোয়াত উপত্যকার মেয়ে মালালা ইউসুফজাই নারী শিক্ষা বিরোধী তালেবান জঙ্গিদের এলাকায় বসে মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পক্ষে বিবিসি ব্লগে লেখালেখি করে যখন পশ্চিমা বিশ্বের নজর কেড়েছিলেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১১। কিন্তু নারী শিক্ষার পক্ষে কথা বলায় তাকে পড়তে হয় প্রাণনাশের হুমকির মুখে।

২০১২ সালের ৯ অক্টোবর সোয়াত উপত্যকার মিনগোরাত এলাকায় ১৪ বছর বয়সী মালালা ও তার দুই বান্ধবীকে স্কুলের সামনেই গুলি করে তালেবান জঙ্গিরা।

‘পশ্চিমাপন্থি’ ও ‘পশতু এলাকায় পশ্চিমা সংস্কৃতি প্রচার’ করার কারণে তাকে গুলি করা হয়েছে বলে ওই সময় দাবি করেছিল পাকিস্তান তালেবান।

পাকিস্তানে তার মাথায় অস্ত্রোপচার করে বুলেট সরিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও পরে যুক্তরাজ্যের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে তাকে উন্নত চিকিৎসা দেওয়া হয়।

ওই ঘটনা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে, মালালার স্বপ্ন সফল করতে ২০১২ সালের ১০ নভেম্বরকে ‘মালালা দিবস’ ঘোষণা করে জাতিসংঘ।