বাঙালির ইতিহাসে বিভীষিকাময় রাতটি বাতি নিভিয়ে স্মরণ করা হল।
রোববার রাত ৯টা বাজতেই এক মিনিটের জন্য নামল অন্ধকার; একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যায় নিহতদের স্মরণে এই ‘ব্ল্যাক-আউট’ কর্মসূচি পালনে সরকারের পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছিল।
একাত্তরের কাল রাত স্মরণে এ ধরনের কর্মসূচি এবারই প্রথম পালিত হল।
সরকারের পক্ষ থেকে আগেই জানানো হয়েছিল, কেন্দ্রীয়ভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ বন্ধ করা হবে না। নিজ নিজ উদ্যোগে বাতি নিভিয়ে এক মিনিট এই প্রতীকী কর্মসূচিতে যোগ দিতে হবে।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কাল রাতের কর্মসূচি পালনকালে ব্ল্যাক আউটের সময় দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে এক মিনিটের ‘ব্ল্যাক আউট’ কর্মসূচি পালন করা হয়। মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে কর্মসূচি পালন শেষে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করেন বলে জানান মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুল্লাহিল মারুফ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম ও সংস্কৃতি সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
আবদুল্লাহিল মারুফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো এই প্রতীকী কর্মসূচি পালন হল। কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রিড লাইন বন্ধ করা সম্ভব ছিল না, তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগের ওপর সব হয়েছে।”
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, নির্বিচারে চলেছিল হত্যাকাণ্ড। ওই রাতে শুধু ঢাকায় অন্তত ৭ হাজার বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল।
পাকিস্তানি বাহিনীর সেই নৃশংসতার পর রুখে দাঁড়িয়েছিল বাঙালি, স্বাধীনতার জন্য শুরু হয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রাম, তার পথ ধরে এসেছিল স্বাধীনতা।
এক মিনিটের ‘ব্ল্যাকআউট’র আগে-পরে আলো জ্বালিয়ে সেই অন্ধকার রাতের ভয়াবহতার কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পালন করে বিভিন্ন সংগঠন।
শহীদ মিনারে ৪৭টি মশাল জ্বালিয়ে আলোর মিছিল বের করে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি।
. .
সন্ধ্যায় প্রদীপ প্রজ্বলনের কর্মসূচি আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরও; মুক্তিযুদ্ধ শহীদদের সন্তান ও নতুন প্রজন্মের একঝাঁক তরুণ-তরুণী মোমবাতি হাতে এই কর্মসূচিতে অংশ নেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচি সমন্বয়ক রফিকুল ইসলাম বলেন, “আজ আমরা অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করছি। আমরা আলো এনেছি। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। যেসব শহীদরা বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আত্মত্যাগ করেছেন, তাদের স্মরণে আজকের আলোক প্রজ্জলন।”
স্মরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মিরপুরের শহীদ আব্দুল হাকিমের ছেলে মো. আব্দুল হামিদ ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আব্দুল মোক্তাদিরের মেয়ে ইলোরা মোক্তাদির।
ইলোরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাবা পাক বাহিনীর শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, এটাই ছিল তার অপরাধ। তারা তালিকা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক মোক্তাদিরকে ২৬ মার্চ ১২ নম্বর ফুলার রোডের বাসায় এসে গুলি চালিয়ে হত্যা করে যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা। ইলোরা ছিলেন তখন মাতৃগর্ভে।
মায়ের কাছে শোনা সেদিনের কথা বলেন ইলোরা।
“বাবাকে গুলি করতে দেখে মা জ্ঞান হারান। পরে তার বাবার লাশ টেনে হিঁচড়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলে ফেলে যায়। আমার দুজন আত্মীয় গিয়ে লাশ এনে নানাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন।
“বাবাকে তারা বলেছিল- ‘তুম জয় বাংলা বলতাহো, পাকিস্তান নেহি মানতা’। তিনি নিশ্চুপ ছিলেন, ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ছিল তার চোখে মুখে। তারা বাবাকে আত্মসমর্পণ করতেও বলেছিল। আমার এক চাচা আত্মসমর্পণ করলেও বাবা করেননি। তাই তাকে হত্যা করা হয়।”
আরেক শহীদ সন্তান আব্দুল হামিদ বলেন, মিরপুর এলাকা বিহারি অধ্যুষিত ছিল। ৭০ এর নির্বাচনে বাবা আওয়ামী লীগের পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। বিহারিরা বাবাকে চিনতেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের কোনো একদিন তারা বাবাকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে।