মুশফিককে নিয়ে এ কী বললেন পাপন!

মুশফিককে নিয়ে এ কী বললেন পাপন!
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের জন্য তখন প্রয়োজন ছিল ১৯ রান, হাতে বল ছিল ১২টি। ১৮তম ওভারের খেলা শুরু। স্ট্রাইকে মুশফিক। ফার্নোন্দোর প্রথম বলে এক রান নিয়ে প্রান্ত বদল করলেন মুশফিক। স্ট্রাইকে সাব্বির রহমান। প্রয়োজন ১১ বলে ১৮ রান। শ্বাসরুদ্ধকর এই মুহূর্তে আউট হয়ে গেলেন সাব্বির। তাতে হতাশ না হয়ে মেহেদী হাসান মিরাজকে নিয়ে দারুণ উদ্দীপনায় এগিয়ে গেলেন অভিজ্ঞ মুশফিক। হাঁকালেন ছক্কা! এই ছক্কাই পেছনে ফেলে দিয়েছে শ্রীলঙ্কাকে। জয় তখন হাতের মুঠোয় চলে আসে বাংলাদেশের। বাকি কাজটাও সেরে ফেরেন মুশফিক। জয়ের নায়ক বনে যান তিনি। তবে তিনি যে ছক্কা হাঁকাতে পারেন তা জানতেনই না বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন।

চার দিনের শ্রীলঙ্কা সফর শেষে কলম্বো ছাড়ার আগে রোববার তিনি বলেন, ''তামিম-সৌম্য যে (ছক্কা) মারতে পারে, সেটা জানি। লিটন মারতে পারে জানতাম না। মুশফিক? ওকে কাল বললাম, তুমি যে এমন মারতে পার, জানতামই না! গত দুই বছর দেখছি, ছয় মারতে গিয়ে সে বাউন্ডারিতে ক্যাচ হয়! ও মারতে পারে। কিন্তু ছয় মারার খেলোয়াড় সে নয়! আমাদের দলে ছক্কা মারে তিনজন- তামিম, সৌম্য আর সাব্বির। সাব্বির অবশ্য ছন্দে নেই।''

উল্লেখ্য, ২০১১ সালের অক্টোবরে মিরপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ম্যাচে ৬ বলে ৬ রানের সমীকরণ মুশফিক মিলিয়ে ছিলেন ছক্কা হাঁকিয়ে। ২০১২ সালের মার্চে ওয়ানডে সংস্করণে হওয়া এশিয়া কাপে ভারতের করা ২৮৯ রান টপকেছিল বাংলাদেশ, সেটিতে শেষ দিকে তীব্র স্নায়ুচাপে ৭ বলের মধ্যে তিনটা ছক্কা মেরে কঠিন সমীকরণটা সহজ করেছিলেন মুশফিকই।

মার্চে বদলে যাওয়া মুশফিক
‘আমাদের সংগ্রহটা ভালোই ছিল। অনেক সময় ২০০ রান করলেও অনুমান করা যায় না যে জেতা সম্ভব। যে কারণে ক্রিকেট সব সময়ই মজার খেলা, যার পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশকে অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হবে। আজকে ওরা ছিল অসাধারণ এবং পরিস্থিতি আমাদের থেকেও ভালোভাবে সামাল দিয়েছে।’ লঙ্কান অধিনায়ক এই উক্তিতে মুশফিককে ধন্যবাদ দিতে একটু কার্পণ্য করলেও ড্যাশিং ওপেনার তামিম মুশফিককে প্রশংসায় ভাসাতে কার্পণ্য করেননি।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৩৫ বল খেলেন মুশফিক। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৭২ রানে। ভারতের বিপে ব্যর্থতার পর ঐতিহাসিক রান তাড়ার জয়- দুটোতেই পাদপ্রদীপের আলোয় ছিলেন মুশফিকুর রহীম। ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপে ভারতের কাছে হারের দুঃসহ স্মৃতির বোঝা অনেক দিন ধরেই বয়ে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে ঐতিহাসিক জয় দিয়ে তার শাপমোচন করলেন। তামিমের কথায়, ‘ব্যাঙ্গালুরুতে যে ভুলটি করেছিল আজকে আর সে ভুলটির পুনরাবৃত্তি করেনি। আমি সব সময়ই মনে করি, খারাপ হোক আর ভালো খেলাই হোক, সব জায়গাতেই শেখার আছে। সেই দিন মুশফিককে যে পরিমাণ সমালোচনার বাণে বিদ্ধ হতে হয়েছিল, আজকে সেই পরিমাণ প্রশংসায় ভাসাতে হবে তাকে।’

টি-২০তে পাওয়ার হিটার নেই বাংলাদেশের। তাই বাংলাদেশী ঘরানার টি-২০ ক্রিকেট মন্ত্রেই উজ্জীবিত তামিম, ‘আমাদের হয়তো সেরকম মানের পাওয়ার হিটার নেই। হয়তো ইংল্যান্ড অথবা ওয়েস্ট ইন্ডিজকে অনুসরণ করতে পারব না। কারণ, আমাদের ধোনির মতো কেউ নেই যে ৭ নম্বরে খেলবে। আবার ক্রিস গেইল নেই, যারা প্রথম বল থেকেই বোলারকে চেপে ধরবে। তবে আমাদের বুদ্ধিদীপ্ত ক্রিকেটার আছে, যারা ব্যতিক্রমী। এই ম্যাচ সত্যিকার অর্থেই আত্মবিশ্বাস জোগাবে। এটা আমাদের সেরা একটি জয়।’

সেটাও ছিল মার্চ মাস। এটাও মার্চ মাস। সেবার পারেননি মুশফিক। হয়েছিলেন খলনায়ক। এবার পেরেছেন মুশফিক। মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলে দলকে অবিশ্বাস্য এক জয় এনে দিয়েছেন। ১ বছর ১১ মাস ১৫ দিনের ব্যবধানে হয়েছেন মহানায়ক।

২০১৬ সালের ২৩ মার্চ টি-২০ বিশ্বকাপে ভারতের ১৪৭ রানের টার্গেটে বাংলাদেশ শুরু থেকে জয়ের ট্র্যাকেই ছিল। ১৯ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ৬ উইকেটে ১৩৬। জয়ের জন্য শেষ ওভারে প্রয়োজন ১১ রান। ক্রিজে দুই নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও মুশফিকুর রহীম। শেষ তিন বলে বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল মাত্র ২ রান। হাতে ৪ উইকেট। হার্দিক পান্ডিয়ার চতুর্থ বলটি উড়িয়ে মারতে গিয়ে ডিপ মিড উইকেটে শেখর ধাওয়ানের তালুবন্দী হন মুশফিক। প্রান্ত বদল করে মাহমুদুল্লাহ তখন স্ট্রাইকে। জিততে প্রয়োজন ২ রান। মুশফিকের মতো মাহমুদুল্লাহও উড়িয়ে মারতে গিয়ে জাদেজার হাতে ধরা পড়েন। শেষ বলে রান নিতে গিয়ে রান আউট হন মুস্তাফিজ। ভারত জিতে যায় ১ রানে। হাতের মুঠোয় থাকা ম্যাচটি বেরিয়ে গেলে মুশফিকের ব্যাপক সমালোচনা হয়। মুশফিকও সব দায় মাথা পেতে নেন।

২৫ মার্চ উইজডেন ইন্ডিয়া পরপর দুইটি চার মেরে উল্লাস করা মুশফিকের ছবি দিয়ে ফিচার করেছিল, ‘মুশফিকুর রহীম অ্যান্ড প্রিম্যাচিউর সেলিব্রেশন।’

সেই হারের ক্ষত নিজের ভেতরই ধারণ করেছিলেন মুশফিক। অবশেষে সেখানে প্রলেপ দিলেন শ্রীলঙ্কার বিপরে ম্যাচে নিদাহাস ট্রফিতে। রেকর্ড ২১৫ রান তাড়া করে দলকে জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন মুশফিক। ৩৫ বলে খেলেন ৭২ রানের বীরোচিত ইনিংস। এবার মুশফিক জয়ের আগেই উল্লাস করেননি। ১৯তম ওভারে ফার্নান্দোকে ছক্কা মেরেও উল্লাস করেননি। উল্লাস করেননি শেষ ওভারের দ্বিতীয় বলে পেরেরাকে ৪ মেরেও। চতুর্থ বলে জয়সূচক রানটি নিয়েই উল্লাস করেছেন নাগিন, নাগিন গানের নাচ দেখিয়ে।

বাংলাদেশ এর আগে কখনো দুই শতাধিক রান তাড়া করে জয় পায়নি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই দুই শতাধিক রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড হাতেগোনা। সেই তালিকায় বাংলাদেশের জয়টি চতুর্থ স্থানে। কলম্বোর আর প্রেমাদাসায় সর্বোচ্চ জয়ের রেকর্ড মাত্র ১৭৫ রান তাড়া করার। ১১ বছর আগে, ২০০৭ সালে উইন্ডিজের বিপে টি-২০ বিশ্বকাপে, ১৬৫ রান তাড়া করে জেতাই সর্বোচ্চ রেকর্ড। 
কিছুদিন আগে মিরপুরে টি-২০ ইতিহাসে সর্বোচ্চ ১৯৩ রান করেও হারতে হলো লঙ্কানদের কাছে। এবার এক ইনিংসেই পুরনো সব কিছু ভেঙে নতুন রেকর্ডের সৃষ্টি করেছেন মুশফিকুর রহীম। সবচেয়ে বড় রেকর্ড হলো উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান তাড়া করার রেকর্ড এখন বাংলাদেশেরই। এর আগে উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ ২০৭ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড রয়েছে ভারতের। ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে।

শ্রীলঙ্কার মাটিতে বাংলাদেশের ২১৫ রান টি-২০তে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। অস্ট্রেলিয়া করেছিল ২৬৩ রান, পাল্লেকেলেতে ২০১৬ সালে। এই টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই ভারতের বিপে ১৭৫ রান করে জিতেছিল শ্রীলঙ্কা, যা প্রেমাদাসায় সর্বোচ্চ রান তাড়া করার রেকর্ড। বাংলাদেশের কাছে এই হারে টি-২০ ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি ৫০তম পরাজয়ের শিকার হলো শ্রীলঙ্কা। এক ধাপ পরেই আছে বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ড। দুই দলই হেরেছে ৪৯টি করে ম্যাচ।