কারও কাছে তিনি হার না মানা যোদ্ধার প্রতীক, কারও কাছে ছিলেন মায়ের মতই আপন; একাত্তরের সেই মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী শেষ বিদায় নিলেন জাতীয় পতাকায় মোড়া কফিনে শুয়ে, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায়।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর চিরবিদায়
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় তার কফিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নিয়ে আসা হলে ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদের নেতৃত্বে এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়।
এরপর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে শুরু হয় শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদন পর্ব। বন্ধু, স্বজন, সহযোদ্ধা আর ভক্তদের শ্রদ্ধার ফুলে ফুলে ভরে ওঠে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কফিন।
শ্রদ্ধা জানানোর পর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, “নারী আন্দোলনের সকল পর্যায়ে তিনি সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার এ কণ্ঠস্বর কখনো পিছপা হয়নি।”
তিনি বলেন, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী একাত্তরের বীরাঙ্গনাদের স্বীকৃতির জন্য যে লড়াই করে গেছেন, সরকার তা এগিয়ে নিয়ে যাবে।
কিডনি ও হৃদরোগের জটিলতা নিয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার মৃত্যু হয় প্রিয়ভাষিণীর। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত এই মুক্তিযোদ্ধার বয়স হয়েছিল ৭১ বছর।
প্রিয়ভাষিণীর মরদেহ মঙ্গল ও বুধবার রাখা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলের হিমঘরে। তার ছোট ছেলে কাজী মহম্মদ শাকের তূর্য অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরলে বৃহস্পতিবার সকালে শুরু হয় শেষযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা।
বেলা ১১টায় এই সংগ্রামী নারীর কফিন নিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আসেন তার মেয়ে রত্নেশ্বরী প্রিয়দর্শিনী, ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী, ছেলে কারু তিতাস ও কাজী শাকের তূর্য।
রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোর পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান দলের সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যে ত্যাগ, তা নতুন প্রজন্মের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। তার ভাস্কর্য শিল্পচর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে, শিল্প পেয়েছে এক নতুন মাত্রা।”
প্রিয়ভাষিণী জীবনভর যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা ধারণ করে গেছেন, দেশের নতুন প্রজন্মও সেই ধারায় শামিল হবে বলে আশা প্রকাশ করেন কাদের।
শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে এসেছিলেন জাসদ, বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টির নেতারাও।
তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বলেন, “সাহস থাকলে যে সব বাধা অতিক্রম করা যায়, তার উদাহরণ ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। তার উপর বারবার আঘাত এসেছে, কিন্তু তিনি বারবার ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি জীবনভর লড়াই করে গেছেন।”
১৯৪৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি খুলনায় ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর জন্ম। তার নানা অ্যাডভোকেট আব্দুল হাকিম ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের সরকারের সময় স্পিকার হয়েছিলেন।
মাত্র ষোল বছর বয়সে প্রিয়ভাষিণীর প্রথম বিয়ে হয়। আট বছরের মাথায় সেই সংসারে বিচ্ছেদ ঘটে, ১৯৭১ সালে যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে সন্তানদের নিয়ে শুরু হয় তরুণ প্রিয়ভাষিণীর অন্য এক লড়াই।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হতে হয় এই বীর নারীকে। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার অবদানের জন্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে মুক্তিযোদ্ধা খেতাব দেয়। তার আগে ২০১০ সালে তিনি পান স্বাধীনতা পুরস্কার।
যুদ্ধদিনের সেই ‘ভয়াবহ’ অভিজ্ঞতা স্মরণ করে ২০১৫ সালে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “১৯৭১ সালে আমি খুলনা ছিলাম। অক্টোবরের শেষের দিকে আমাকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়…৩২ ঘণ্টা আমাকে আটকে রাখা হয়েছিল। এমন কোনো নির্যাতন নেই, যা তারা করেনি। আমার জীবনে সে এক দুঃসহ স্মৃতি।”
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সরকারি কর্মকর্তা আহসান উল্লাহর সঙ্গে নতুন করে সংসার শুরু করেন ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী। ১৯৭৭ সাল থেকে দুই দশকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি কাজ করেছেন।
এক সময় তিনি মন দেন শিল্পের সাধনায়। ঝরা পাতা, শুকনো ডাল, গাছের গুঁড়ি দিয়ে তার তৈরি গৃহসজ্জার উপকরণ ও শিল্পকর্ম তাকে ধীরে ধীরে করে তোলে ভাস্কর।
প্রিয়ভাষিণীর প্রথম আনুষ্ঠানিক প্রদর্শনী হয় যশোরে শিল্পকলা একাডেমিতে। চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান সেই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিলেন।
ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসে এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “তিনি একইসাথে সাহস ও সম্ভ্রমের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তার অবদান অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সংস্কৃতি চর্চায় তার ভাস্কর্য এক নতুন সংযোজন। নতুন প্রজন্ম তার সম্পর্কে ভালোভাবে জানলে দেশকে আরো ভালোভাবে জানতে পারবে।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিপক্ষে আজীবন প্রিয়ভাষিণীর সোচ্চার অবস্থানের কথা শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে স্মরণ করেন রামেন্দু মজুমদার।
কামাল লোহানী বলেন, “তিনি ছিলেন সাহসী নারীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতনের কথা লুকিয়ে না রেখে লোকসমাজে তা প্রকাশ করেছেন। নির্যাতিত নারীর পক্ষে দাঁড়িয়ে তিনি অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। তার অনন্য অবদানের কথা ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে।”
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ছাড়াও বাংলাদেশ নারী পরিষদ, জাতীয় কবিতা পরিষদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, আইন ও সালিস কেন্দ্র, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়,একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পক্ষেও শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রিয়ভাষিণীর কফিনে।
তার পরিবারের পক্ষে মেয়ে ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী বলেন, “মা গত চার মাস ঘর থেকে বের হতে পারেননি। তিনি ফাল্গুন দেখেননি, আজ আপনারা এত ফুলে মাকে ফাল্গুন উপহার দিলেন।”
মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কবরের পাশে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর দাফন হবে জানিয়ে তার মেয়ে বলেন, “মা তার শেষ ঠিকানা পেয়েছেন, মা ঘুমাবেন জাহানারা ইমামের পাশে। আমরা গর্বিত।”
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সবার শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জানাজার জন্য প্রিয়ভাষিণীর কফিন নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। বিকালে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হবে একাত্তরের এই যোদ্ধা মাকে।
আগামী ১৩ মার্চ বিকাল সাড়ে ৪টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর স্মরণে নাগরিক শোকসভার আয়োজন করবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।