গাইবান্ধায় প্রায় শুকনো তিস্তা। ছবি: লেখক
নদীর মানচিত্র ধরে রংপুর বিভাগের নদীগুলোর খোঁজ করেছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তুহিন ওয়াদুদ। কেমন অভিজ্ঞতা হলো? তিনি লিখেছেন সে কথা
অনেকের কাছে মনে হতে পারে নদী আবার খোঁজার কী আছে? নদী যে খোঁজারই বিষয়, তার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার। যে নদীর নাম আমরা সবাই জানি, সেই নদী খোঁজার কোনো কারণ নেই। কিন্তু আমাদের দেশে যে সহস্রাধিক নদী আছে, তা সত্যিই খুঁজে বের করা রোমাঞ্চকর ব্যাপার।
২০১০ সালে আমরা প্রতিষ্ঠা করি ‘রিভারাইন পিপল’ নামের একটি সংগঠন। নদী নিয়েই কাজ করা আমাদের লক্ষ্য। কোন নদী কেমন আছে, কেমন ছিল, ভবিষ্যতে এগুলোর অবস্থা কী হবে, তা জানার চেষ্টা করি। এ পর্যন্ত শুধু রংপুর বিভাগেই শতাধিক নদীতে গিয়েছি। কয়েক বছর ধরে নদী খুঁজে বের করার কাজটি করছি। এমন অনেক নদী পেয়েছি, যেগুলো বর্তমানে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় নেই। এমনও নদী পেয়েছি, যেগুলো আন্তসীমান্ত নদী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন স্বীকৃত নয়।
পঞ্চগড়ে করতোয়া নদী যেন ফসলি জমি
পঞ্চগড়ে করতোয়া নদী যেন ফসলি জমি
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
গিয়েছিলাম নীলফামারী জেলায়। এ জেলায় অন্যতম একটি বন্দর ছিল, নাম শাখামাছা বন্দর। এই বন্দর গড়ে উঠেছিল বামনডাঙ্গা নদীর তীরে। একদিন সেই বামনডাঙ্গা নদী খুঁজতে বের হই। পেয়েও যাই। কিন্তু যে বিশালায়তন নদীর পাশে বন্দর গড়ে উঠেছিল, সেই নদীর করুণ অবস্থা দেখলে যে কারোরই মন খারাপ হবে। লাফ দিয়ে পার হওয়া সম্ভব সেই নদী। সেই শাখামাছা বন্দর এখন বড় বাজার নামে পরিচিত।
একদিন একটি বই পড়ে জানলাম, আদি রংপুর মাহীগঞ্জ শহর গড়ে উঠেছিল ইছামতী নদীর পাশে। এটি জানার পর আমার মধ্যে আগ্রহ তৈরি হয়। রংপুরে যে ইছামতী নদী আছে, তা তো কারোরই কাছে শুনিনি। বরং আগে জানতাম ঘাঘটের পাড়ে গড়ে উঠেছিল আদি রংপুর। তবু সেই ইছামতী খুঁজতে বের হলাম। প্রথম দিন ফিরে এসেছি। পরে আরেকদিন গিয়ে একটি সরু নালা দেখে মনে হলো এটিই হয়তো হবে সেই ইছামতী নদী। কারণ এই সরু নালা ছাড়া ওখানে আর কোনো জলপ্রবাহ নেই। একটি সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে অনেককে জিজ্ঞেস করতে শুরু করি, এটা নদী কি না। নদী হলে তার নাম কী? কিন্তু দুঃখজনক হলো, অনেকেই বললেন তাঁরা জানেন না এটি নদী নাকি খাল।
সড়কের পাশে একটি টিনের বাড়ি ছিল। আমার নদী খোঁজা দেখে বাড়ির ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ নারী বললেন, ‘বাবা, শুনছি এটা নাকি ইছামতী।’ তখন আমার বিশ্বাস হলো ইছামতী নামে রংপুরে একটি নদী আছে। তবে নদীর পাশে যাঁরা আদি বাসিন্দা, তাঁরা সবাই জানেন এটি ইছামতী। পরবর্তী সময়ে মোনালিসা রহমানের মাহীগঞ্জের কথা বই পড়ে জানতে পারি এই নদীর তীরে গড়ে ওঠা ব্যবসা-বাণিজ্যের কথা।
নদী মানচিত্রে নদী দেখতেই চোখে পড়ে ধরলা থেকে কিছুটা পশ্চিমে এবং তিস্তা থেকে কিছুটা পূর্বে একটি নদী। নাম ত্রিমোহিনী। কারও কাছে কখনো শুনিনি সেখানে ত্রিমোহিনী নদী আছে। কুড়িগ্রামের একটি স্থানেরও নাম ত্রিমোহিনী। একদিন ওই ত্রিমোহিনীতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে নদী নিয়ে আলাপ করি। স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, ত্রিমোহিনী নামক স্থানে একটি নদী ছিল। কেউ কেউ বললেন, উপজেলা পরিষদের সামনে যে পুকুর আছে, সেটি আসলে ওই নদীর শেষ অংশ।
নদী যে শুধু প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠে তা নয়। কখনো কখনো খনন করেও নদী তৈরি করা হয়েছে। রংপুরের একটি নদীর নাম আখিরা। এই নদী কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা। ১১৭৬ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য পরিবহনের প্রয়োজনে জলপথ তৈরির জন্য একটি খাল খনন করা হয়েছিল। এই খালের সঙ্গে সংযোগ ছিল করতোয়ার। পরবর্তী সময়ে এই খাল অনেক বড় নদীতে পরিণত হয়েছিল। এখন আবারও সেই খালে পরিণত হয়েছে।
দিনাজপুরের আত্রাই
নদী খুঁজতে গিয়ে কিছু মৃত নদীর সন্ধান পাই। নীলফামারীর সৈয়দপুর বাসস্ট্যান্ডের পাশে সর্বমঙ্গলা নামে একটি নদী ছিল। এখন এই নদী শুধু নামের মধ্যে বেঁচে আছে। ঠাকুরগাঁও জেলায় ভক্তি নামের একটি নদী ছিল একসময়। অনেকেই বলেন, সেখানে তিন শ বছর আগে জাহাজ ডুবে মারা গিয়েছিলেন সওদাগর। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থেকে ভূরুঙ্গামারী যাওয়ার সময় একটি স্থানের নাম মাসামকুড়া। মাসামকুড়া নদীর কোন স্থানে সওদাগর সপরিবার ডুবে মারা গেছে, সেই গল্প স্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে মিথের মতো কাজ করছে। এখন আর সেই নদীর অস্তিত্ব নেই। নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলার নাউতারা নামক বাজারটি গড়ে উঠেছে নাউতারা নদীর পাশেই। একসময় বলা হতো নাউতারার বন্দর। এখন নদীও মৃতপ্রায়, বন্দর নেই। সাধারণ মানুষও এখন তাই বলেন নাউতারার বাজার। নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বড়ঘাট নামক স্থানটিতেও নদী ছিল।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছে ছিল এই অঞ্চলের বড় একটি বন্দর। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে জাহাজ আসত এখানে। ইংরেজরা জলপথে এসে হারাগাছে তামাক চাষের সূত্রপাত করে। বর্তমানেও হারাগাছ বিড়ি তৈরির জন্য বিখ্যাত। তবে সেই বন্দরনগরীর আর কোনো প্রামাণ্য কিছুই নেই। নদীকে কেন্দ্র করে লালমনিরহাটের বড়বাড়ি ছিল প্রশাসনিক স্থান। তার পাশে সপ্তম শতকের যে হারানো মসজিদ আবিষ্কৃত হয়েছে, তা-ও ছিল নদীতীরবর্তী।
নদীর খোঁজ করতে গিয়ে বিচিত্র অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তবে নদী খোঁজার আনন্দই আমাকে অক্লান্ত নদীকর্মীতে পরিণত করেছে।