এই দেশগুলো ছাড়া আর কেউ এবার বিশ্বকাপ জিতবে না

এই দেশগুলো ছাড়া আর কেউ এবার বিশ্বকাপ জিতবে না
রাশিয়া বিশ্বকাপ শুরু হতে আর বাকি ৭৫ দিন। কারা জিতবে এবারের বিশ্বকাপ, তাই নিয়ে এখন থেকেই জল্পনা-কল্পনা তুঙ্গে। মূল পর্বে ৩২টি অংশগ্রহণকারী দেশের মধ্যে খেতাবের আসল দাবিদার মাত্র পাঁচটি দেশ। এরা হলো, বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, পাঁচবার বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল, দুরন্ত পাসিং গেম খেলা স্পেন, তারুণ্য ও প্রতিভায় ভরপুর ফ্রান্স এবং লিওলেন মেসির আর্জেন্টিনা।

এপ্রিল ও মে মাসে ক্লাব ফুটবলে আট-দশটি মরণ-বাঁচন ম্যাচ খেলতে হবে ইউরোপের নামী দলগুলোকে। ভাগ্য বিরূপ হলে যে কোনো নামী তারকা ফুটবলার চোট-আঘাত পেয়ে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে যেতে পারেন। আগামী দুই মাসের মধ্যে কোনো তারকা বড় ধরনের চোট পেলে তার পক্ষে রাশিয়া বিশ্বকাপে খেলা সম্ভব হবে না।

প্রথমেই বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানিকে নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক। ইউরোপের এক ঝাঁক শীর্ষস্থানীয় ফুটবলারে সমৃদ্ধ ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষ স্থানাধিকারী জার্মানি এবারও বিশ্ব খেতাবের বড় দাবিদার। প্রায় এক যুগ জার্মান দলটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন কোচ জোয়াকিম লো। কে কোথায় কেমন খেলছে তা তিনি ইউরোপের বিভিন্ন স্টেডিয়ামে গিয়ে চাক্ষুষ করে থাকেন। তাই তার পছন্দের তালিকা বেশ দীর্ঘ। আপফ্রন্টে গোল করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা রয়েছে জোয়াকিম লো ব্রিগেডের। কারণ গার্ড মুলার, জুরগেন ক্লিন্সম্যান কিংবা মিরোস্লাভ ক্লোজের পর জার্মানি আর কোনো ম্যাচ উইনিং স্ট্রাইকার পায়নি। তাই এখনও মধ্য ত্রিশ উত্তীর্ণ মারিও গোমেজকে ছেঁটে ফেলতে পারছেন না কোচ জোয়াকিম লো।

আমরা জানি, জার্মানরা ম্যাচের শেষ বাঁশি বাজার আগে হার মানতে শেখেনি। তবে ইদানীং তাদের খেলায় এই মানসিকতায় কিঞ্চিৎ ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যার প্রমাণ মিলেছে কয়েকদিন আগে ব্রাজিলের কাছে হারা ম্যাচে। কোচ জোয়াকিম লো ওই পরাজয়ের পর বলেছিলেন, ‘আত্মতৃপ্তি যে কোনো দলের সবচেয়ে বড় শত্রু। আমি জার্মানির টিম বাসে একটা শ্লোগান লিখে টাঙিয়ে দিয়েছি- ‘দ্য বেস্ট নেভার রেস্ট।’ এছাড়া ছেলেদের বলেছি, বিশ্বকাপ আজ অবধি এমন কোনো দেশ জেতেনি, যারা আগের বছর ফিফা কনফেডারেশন কাপ জিতেছে।’

পুরোপুরি দ্বিতীয় সারির দল নামিয়েই গত বছর কনফেডারেশন কাপ জিতেছিল জার্মানি। তরুণ ফুটবলারদের যোগ্যতা যাচাই করে নিতে কনফেডারেশন কাপকে অত্যন্ত সফলভাবে ব্যবহার করেছিলেন জোয়াকিম লো। টনি ক্রুজ, মেসুট ওজিল, স্যামি খেদিরা, জুলিয়ন ড্র্যাক্সলার সমৃদ্ধ জার্মানির মাঝমাঠও দারুণ শক্তিশালী। টমাস মুলারের বিশ্বকাপে দশটি গোল রয়েছে বটে, তবে তিনি মিরোস্লাভ ক্লোজের মতো ম্যাচ উইনার নন। গোলের নিচে ম্যানুয়েল ন্যুয়েরের শারীরিক সুস্থতা নিয়ে বিস্তর সংশয় রয়েছে। তিনি না খেলতে পারলে জার্মানির দুর্গরক্ষা করবেন আন্দ্রে টের স্টেগেন। তৃতীয় গোলরক্ষক কেভিন ট্র্যাপ।

পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল এবারও ইউরোপ থেকে বিশ্বকাপ তুলে নিয়ে যেতে পারে। যে কীর্তি তারা প্রথমবার গড়েছিল ১৯৫৮ সালে সুইডেনের মাঠে। লাতিন আমেরিকান জোনে বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে দুঙ্গার কোচিংয়ে প্রথম ৬টি ম্যাচের পর খুবই করুণ অবস্থা হয়েছিল ব্রাজিলের। তারপর তিতে ব্রাজিল দলের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল সাম্বা ব্রিগেড। বাছাই পর্বের ম্যাচে পর পর জিতে চার ম্যাচ বাকি থাকতেই বিশ্বকাপের মূলপর্বের টিকিট জোগাড় করে নেয় ব্রাজিল। এই পর্বের ম্যাচগুলিতে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে নিয়েছেন কোচ তিতে। এখন তার সামনে দলগঠনের ছবিটা খুবই পরিষ্কার।

২০১৪ সালে বেলো হরাইজন্তেয় গত বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে জার্মানির কাছে ১-৭ গোলে চূর্ণ হওয়ার যন্ত্রণা এখনও বিদ্ধ করে ব্রাজিলের ফুটবলপ্রেমীদের। ওই টিমের অর্ধেকেরও বেশি প্লেয়ারকে ছাঁটাই করে দিয়েছেন তিতে। একইসাথে তিনি সাম্বা ফুটবলের রোমান্টিক ভিশন ছেড়ে আজ অনেক বেশি বাস্তববাদী কৌশল নিয়ে এগচ্ছেন। কী সেই কৌশল? আগে রক্ষণ মজবুত রেখে মাঝমাঠ জমাট করে আক্রমণের ঝড় তোলা। তার বড় সম্পদ দুই উইং ব্যাক মার্সেলো ও ড্যানি আলভেস। এই দুই উইং ব্যাক ঝড়ের গতিতে ওভারল্যাপে উঠে ট্র্যাডিশনাল উইঙ্গারের মতো বিপক্ষের রক্ষণে ক্রস সেন্টার ভাসিয়ে দেন। আর ডিফেন্সিভ মিড ফিল্ডার হিসাবে তিতে এখন নিয়মিত প্রথম একাদশে রাখছেন কাসেমিরো, ফার্নান্দিনহো এবং পরিবর্ত হিসাবে পাওলিনহোকে। ক্রিয়েটিভ মিডফিল্ডার তার হাতে রয়েছে পর্যাপ্ত। তার মধ্যে ফিলিপ কুতিনহো, উইলিয়ান এবং রবার্তো ফারমিনো যে কোনো দলের সম্পদ।

আপফ্রন্টে নেইমার আশা করা যায়, বিশ্বকাপের আগে সম্পূর্ণ ফিট হয়ে উঠবেন। তার পাশে গ্যাব্রিয়েল হেসাস হয়তো খেলবেন। গোলে অ্যালিসন ও এডারসন দু’জনেই বিশ্বমানের গোলরক্ষক। তবে রোমার অ্যালিসনের খেলার সম্ভাবনা বেশি। আর ডিপ ডিফেন্সে দুরন্ত ফর্মে রয়েছেন থিয়াগো সিলভা ও মিরান্দা। মার্কুইনহোসও তৈরি থাকবেন।

অনেকে ভেবে থাকেন, স্প্যানিশ ফুটবলে গর্বের দিন বোধহয় শেষ হতে চলেছে। কিন্তু এই বর্তমান কোচ লোপেতোগুইয়ের আমলে স্পেন আগামী বিশ্বকাপে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। হয়তো দাভিদ ভিয়া কিংবা ফার্নান্দো তোরেসের মতো বড় মাপের স্ট্রাইকার এখন স্প্যানিশ ব্রিগেডে নেই। কিন্তু এবার আপফ্রন্টে ডিয়েগো কস্তাও কারও থেকে কম যান না। স্পেনের মাঝমাঠ প্রায় সোনা দিয়ে বাঁধানো। দাভিদ সিলভা, আন্দ্রে ইনিয়েস্তা, ইসকো, মার্কো অ্যাসেন্সিও মনে হয় প্রথম একাদশে থাকবেন। দুই উইংব্যাক যথাক্রমে জর্ডি আলবা ও ড্যানি কার্ভাহাল। ডিপ ডিফেন্সে যথারীতি ক্যাপ্টেন সের্গিও র‌্যামোস ও জেরার্ড পিকে। গোলে ডেভিড ডি গিয়া। মাঝমাঠে থিয়াগো আলকান্তারাও তৈরি থাকবেন।

এবার বিশ্বকাপগামী ফ্রান্স দলের সবচেয়ে বড় সম্পদ একঝাঁক তারুণ্যে ভরপুর প্রতিভাবান ফুটবলার। বর্তমান কোচ দিদিয়ের দেশঁ’র নেতৃত্বে ঘরের মাঠে ১৯৯৮ সালে আমি ফ্রান্সকে বিশ্বকাপ জিততে দেখেছিলাম। প্যারিসের স্টেড দ্য ফ্রঁসেতে ব্রাজিলকে সেইবার বিশ্বকাপ ফাইনালে ভূপতিত করেছিল জিনেদিন জিদানের হেডে করা পরপর দুটি গোল। সেই শেষবার কোনো আয়োজক দেশ নিজেদের মাঠে বিশ্বকাপ জিতেছিল। এবার ফ্রান্সের আপফ্রন্টে বড় ভরসা গ্রিজম্যান। তিনি কনফেডারেশন কাপে ছয়টি গোল করেছিলেন। এছাড়া রয়েছে কিলিয়ান এমবাপে, ওসমান ডেম্বেলে, অলিভার জিরু’র মতো গোল স্কোরার। মাঝমাঠে পরিশ্রমী মিডফিল্ডার এনগোলো কান্তে যে কোনও দলের সম্পদ। গেমমেকার হিসাবে পল পোগবা ফরাসি ব্রিগেডের বড় ভরসা। ফ্রান্সের ডিপ ডিফেন্সে রাফায়েল ভারানে ও স্যামুয়েল উমতিতি দারুণ ফর্মে রয়েছেন। গোলে হুগো লরিসও প্রায় দুর্ভেদ্য।

সবশেষে আসা যাক লিওলেন মেসির আর্জেন্টিনা প্রসঙ্গে। ডিয়েগো ম্যারাডোনার দেশে এখন শ্লোগান- ‘হয় এবার নয় নেভার’। লিও মেসির পক্ষে বিশ্বকাপ জেতার এটাই শেষ সুযোগ। এমনকী আগুয়েরো, মাসচেরানো, মেসি, ওটামেন্ডি সহ মোট ছয়জন ফুটবলার ২০২২ সালের দোহা বিশ্বকাপে খেলতে পারবেন কি না তা এখন নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়।

আর্জেন্টিনার ফরোয়ার্ড লাইন বিশ্বের সেরা। যে দলে পাওলো ডায়বালার মতো ফরোয়ার্ড সুযোগ পায় না সেই দলের প্রতিভার প্রাচুর্য্য নিয়ে নতুন করে কিছু বলার দরকার পড়ে না। মেসির পাশে গঞ্জালো হিগুয়েন ও সার্জিও আগুয়েরোর খেলার সম্ভাবনা বেশি। মাঝমাঠে যদি অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া টপফর্মে খেলেন তবে আর্জেন্টিনা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া রয়েছেন মাওরো ইকার্ডি’র মতো ফরোয়ার্ড। সাম্পাওলির এই দলটি অবশ্য পুরোপুরি মেসি নির্ভর। মেসি প্রতি ম্যাচে হয় গোল করে নতুবা অ্যাসিস্ট বাড়িয়ে দলকে জেতাবেন, আর বাকিরা গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবে এই জিনিস বছরের পর বছর চলতে পারে না।

এই কয়েকদিন আগে স্পেনের কাছে প্রীতি ম্যাচে ১-৬ গোলে আর্জেন্টিনার বড় পরাজয় অবশ্যই সাম্পাওলি ব্রিগেডের কাছে এক বিশাল ধাক্কা। তবে ওই ম্যাচে মেসি অ্যাগুয়েরোরা খেলেননি।

এছাড়া আউটসাইড চান্স রয়েছে বেলজিয়াম, পর্তুগাল ও ইংল্যান্ডের। তবে এদের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।