এমন একজন পরিচালক দরকার, যে আমাদের দু’জনকে হ্যান্ডেল করতে পারবে

এমন একজন পরিচালক দরকার, যে আমাদের দু’জনকে হ্যান্ডেল করতে পারবে

সাক্ষাৎকারের পরই ঋতুপর্ণা চলে গেলেন পোশাক বদলাতে। এবং সবাইকে অবাক করে তৈরি হয়ে গেলেন ঠিক সাত মিনিটের মাথায়! দু’জনেই নিজের কাজে ব্যস্ত।
এজেসি বোস রোডের কাছে এক পাঁচতারা হোটেলের দু’টো পাশাপাশি প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইট। একটা ‘দাদা’র, আরেকটা ‘দিদি’র। এবং তাঁদের ঘিরে গোটা ফ্লোর জুড়ে ছোটাছুটি করছেন অন্তত জনা তিরিশেক লোক। কখন তাঁরা নীচের কফিশপে সাক্ষাৎকার দিতে নামবেন, কখন তাঁরা উপরে উঠে চেঞ্জ করবেন, কখন তাঁরা লাঞ্চ করবেন, কখন শুরু হবে ফোটো-সেশন— ‘দাদা’-‘দিদি’র সঙ্গে তাল মেলাতে ব্যস্ত সকলে।

এই ‘দাদা’-‘দিদি’ যখন টলিউডের সবচেয়ে বড় তারকা-জুটি, তখন তাঁদের নিয়ে এই ব্যস্ততাই প্রত্যাশিত। কিন্তু যেটা অবাক করার মতো, সেটা হল প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়-ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তর নিজেদের তালমিল। ছবির প্রচারের ফাঁকেই তাঁরা কিন্তু নিজস্ব হাজারটা কাজ সারছেন। কেউ মিটিং করে নিচ্ছেন টুক করে, কেউ সামলাচ্ছেন অন্য কোনও ঝামেলা। সাক্ষাৎকারের পরই ঋতুপর্ণা চলে গেলেন পোশাক বদলাতে। এবং সবাইকে অবাক করে তৈরি হয়ে গেলেন ঠিক সাত মিনিটের মাথায়! দু’জনেই নিজের কাজে ব্যস্ত। রেকর্ডার অফ করলেই তাঁদের বিশেষ কথা হচ্ছে না। অথচ ক্যামেরার শাটার পড়তেই যেন সম্পূর্ণ অন্য দু’জনকে ফ্রেমে পাওয়া যাচ্ছে। ‘আরেকটু মাথা ঘোরা, মুখে আলোটা পড়ছে না’, ‘আরেকটু ক্লোজ এলে ছবিটা ভাল হবে’.... একে অপরকে নানা রকম নির্দেশ অনবরত দিয়ে যাচ্ছেন।

ওবেলা: একে আপনাদের ম্যাজিক জুটি। তার উপর সদ্য জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। ‘দৃষ্টিকোণ’ নিয়ে নিশ্চয়ই আপনারা খুব কনফিডেন্ট?

প্রসেনজিৎ: আমরা ইয়ার্কি মেরে বলি, কৌশিক যদি ঠিক করে একটা ছবি পুরস্কারের জন্য বানাবে, সেটা ঠিক পেয়েও যায় (হাসি)। অবশ্য আমরা খুবই গর্বিত যে, ও সেই জায়গাটা তৈরি করতে পেরেছে। তাছাড়়াও বাঙালিরা কিন্তু ওর ছবির জন্য অপেক্ষা করে থাকে। সে ও বছরে যতগুলো ছবি-ই বানাক না কেন। এমন একজন পরিণত পরিচালক যখন আমাদের কাছে একটা গল্প নিয়ে এল, সেটা অবশ্যই আলাদা হতে হবে। ‘প্রাক্তন’এর পর কি আমরা কোনও প্রস্তাব পাইনি? প্রচুর পেয়েছি। কিন্তু এখন তো সিনেমার ভাষাটা পাল্টে গিয়েছে। তাই এমন গল্প খুঁজছিলাম, যেটা শুনে মনে হবে এটা প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা ছাড়া হবে না!
ঋতুপর্ণা: কৌশিকদা’র গল্পগুলো এত মর্মস্পর্শী যে দর্শককে সহজেই ছুঁয়ে যায়। আমার কৌশিকদা’র সঙ্গে একটাও কাজ করা হয়নি এর আগে। রাজি হওয়ার সেটা একটা বড় কারণ ছিল। তার উপর আমাদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করতে চাইলে পরিচালকের সেই যোগ্যতাও থাকতে হবে। এমন একটা গল্প আনতে হবে, যেটায় আমাদের জুটির সেই ম্যাজিকটা ধরা পড়বে। আসলে দর্শক আমাদের জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করে থাকেন। আমাদের ছবি মানে সকলে ভাবেন, ‘না-জানি কী পেতে চলেছি’! সেই প্রত্যাশার কথাটা তো মাথায় রেখে ছবি বাছতে হয় আমাদের।
প্রসেনজিৎ: আরও একটা বড় বিষয় ছিল, এমন কিছু করব যেটা আগে হয়নি। লোকে প্রেমের গল্প অনেক দেখেছে। কিন্তু এই ধরনের প্রেমের গল্প বাংলা সিনেমায় আগে দেখেনি। প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণাকে যে এভাবেও পরদায় দেখা যায়, সেটা ভাবতেও পারবেন না দর্শক।

ওবেলা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, উত্তম-সুচিত্রার পর আপনাদের জুটিই শেষ সেই ম্যাজিকটা তৈরি করতে পেরেছে। তারপর অনেক চেষ্টা করেও অন্য কোনও জুটি সেটা পারেনি।

ঋতুপর্ণা: এখন কিন্তু জুটির ধারণাটাও বদলে গিয়েছে। কনটেন্টই আসল। তাই অনেক গল্পে সেভাবে জুটি থাকছে না, অভিনেতারা থাকছেন। তবে কী জানেন, জুটি তো আমাদের তৈরি করা নয়। ওটা দর্শকই পারেন তৈরি করতে। আমাদের দু’জনকে একসঙ্গে দেখলে দর্শকের মধ্যে যে আলোড়নটা হতো, সেটা বোধহয় এখন অন্য কোনও জুটিকে দেখলে হয় না। ১৫ বছর আমরা কিন্তু আলাদা কাজ করেছি নিজের মতো। পরদায় বা পরদার বাইরে কখনওই একসঙ্গে আসিনি। কিন্তু লেখাপত্রে, দর্শকের মনে হয়তো আমাদের নিয়ে চর্চা হতো। তাই ১৫ বছর পরও যখন পরদায় ফিরলাম, সেই অনুরণনটা ধরা পড়েছে। সেটা দর্শকের মনে রয়ে গিয়েছিল বলেই ‘প্রাক্তন’ অত সফল হতে পেরেছে। আমাদের নিয়ে এখনও দর্শক এত প্যাশনেট, আই থিঙ্ক উই আর ব্লেসড। 
প্রসেনজিৎ: আর এই চাহিদাটা কিন্তু অনেকগুলো প্রজন্ম ধরে রয়ে গিয়েছে। প্রজন্ম পাল্টে গিয়েছে। কিন্তু এখনও কমবয়সি থেকে প্রবীণ সকলেই আমাদের একসঙ্গে দেখার জন্য মুখিয়ে থাকেন।

ওবেলা: ‘প্রাক্তন’এর পর প্রচুর প্রস্তাব পেয়েছিলেন বললেন। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সেগুলো নাকচ করেন?

প্রসেনজিৎ: হ্যাঁ, কথা তো বলেই নিই। অনেক এমন স্ক্রিপ্ট এসেছে যেগুলো কিন্তু খারাপ নয়। তবে একসঙ্গে করার মতো নয়। আমি কিছু ছবি করেওছি। ওকে হয়তো বলেছি, ‘এটা না তুই করিস না’। ও-ও হয়তো কখনও বলেছে, ‘গল্পটা ভালই কিন্তু একসঙ্গে না করলেই বোধহয় ভাল হবে’। ‘দৃষ্টিকোণ’ পড়েই আমরা সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিই এটা আমাদের করা উচিত।
ঋতুপর্ণা: আসলে সেই স্পেক্টাক্‌লটা থাকতে হবে।
প্রসেনজিৎ: সঠিক গল্পের জন্য আমরা অপেক্ষা করতে চাই। সেটা পাঁচ বছর হলেও ক্ষতি নেই। কারণ একটা সময় যখন আমরা সত্যিই সিনিয়র হয়ে যাব, তখনও যদি একসঙ্গে ছবি করি, ম্যাজিকটা যেন থেকে যায়। কারণ ইতিহাস তৈরি হয়ে যায়, কিন্তু সেটা ধরে রাখা খুব মুশকিল।
ঋতুপর্ণা: এর জন্য সঠিক ছবি, সঠিক পরিচালক বাছাই করাটা খুব দরকার।
প্রসেনজিৎ: আমাদের জুটিটা হ্যান্ডেল করতে পারবে, এরকম পরিচালকের প্রয়োজন। একে তো দু’জনেই অভিজ্ঞ। আলাদা করে যদি ভাবি, তাহলে আমরা দু’জনেই খুব বড় স্টার। সেটা নিয়ে আমাদের ঝগড়া আছে, ইগো আছে। এগুলো তো আমাদের বাইরে রাখলে চলবে না। সেরকম একজন পরিচালক দরকার যে আমাদের দু’জনকে আলাদাভাবে হ্যান্ডেল করে কাজটা ভাল করে বার করে নিতে পারবে। সেদিক থেকে শিবু (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়) একদম পারফেক্ট ছিল।
ঋতুপর্ণা: শিবু আমার খুবই কাছের বন্ধু। অনেকদিন ধরেই আমাদের জুটিটা নিয়ে ওর ছবি করার ইচ্ছে ছিল। আমি বলেছিলাম, তেমন বিষয় আনতে 
পারলে করব।
প্রসেনজিৎ: আমরা কিন্তু ‘প্রাক্তন’এর আগে ওর বেশ কিছু গল্প নাকচ করে দিই। বলেছিলাম, ‘দিস ইজ নট ফর আস’।
ঋতুপর্ণা: শিবু খুবই ক্রিয়েটিভ। আর ভাবনাচিন্তাগুলো খুব পরিষ্কার। নন্দিতাদি (রায়) অসাধারণ স্ক্রিনপ্লে লেখে। সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল শুরুটা ওদের দিয়েই করা উচিত। এত বছর পর আমাদের জুটির যে দরজাটা খুলল, সেটা আমি চেয়েছিলাম, ওরাই খুলুক। আর সকলে যেভাবে আমাদের স্বাগত জানিয়েছেন, সেটা তো এবার ধরে রাখতেই হবে।
প্রসেনজিৎ: আমরা চেয়েছিলাম, ‘দৃষ্টিকোণ’ দেখতে বসে কেউ যেন ‘প্রাক্তন’এর কথা না ভাবে। তেমন ছবি বাছাই করাটা কিন্তু খুব চ্যালেঞ্জিং। কারণ এখন তো সিনেমার কোনও ফর্মুলা হয় না।
ঋতুপর্ণা: কৌশিকদা কিন্তু খুব সেনসিটিভ অথচ সহজ ভাষার পরিচালক। এমন একটা গল্প লিখেছে যেটা মানুষের প্রেমের ধারণা বদলে দেবে। ‘প্রাক্তন’ দেখেও অনেকের অনেক ধারণা বদলে গিয়েছিল। অনেক সম্পর্কের সমস্যা মিটে গিয়েছিল। এগুলো তো আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি।

ওবেলা: বার বার সঠিক পরিচালকের কথা বলছেন। আপনাদের কাছে নাকি একটা তৈরি তালিকা রয়েছে, যাঁদের সঙ্গে জুটি হিসেবে কাজ করবেন

ঋতুপর্ণা: না, না। আমি কোনও তালিকায় বিশ্বাস করি না।
প্রসেনজিৎ: আমরা কিন্তু নতুন পরিচালকের সঙ্গেও কাজ করতে পারি যদি তার গল্পে সেই স্পার্কটা দেখতে পাই। আমরা আগে এমন অনেক নতুনদের সঙ্গে কাজ করেছি যাঁরা এখন স্টার পরিচালক। নতুনরা অনেকেই ভাল কাজ করছে। কিন্তু দু’টো বড় ব্র্যান্ডের দায়িত্বটা নিতে পারবে, সেই গ্যারান্টি তাকে দিতে হবে।

ওবেলা: ঋতুপর্ণা, আপনি একসঙ্গে এতগুলো কাজ করেন। এত ধরনের কাজ করেন। প্রসেনজিৎ, আপনার কাজের ধরন আবার একদম উল্টো। যখন যে ছবিটা করেন, সেটায় মনোযোগ দেন। দু’জনের কাজের ধরন নিয়ে কী মত?

ঋতুপর্ণা: মাল্টিটাস্কিংয়ের মধ্যে আমি একটা আলাদা মজা পাই। ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত মানে শুধু যে তাঁর ছবিগুলো নয়, সেই পরিচিতিটা ধরে রাখতে চাই। অনেক রকম কাজ একসঙ্গে না করলে নিজেকে কীভাবে চ্যালেঞ্জ করব, নিজের ভার্সেটালিটিটা কীভাবে ধরে রাখব!
প্রসেনজিৎ: আমি গত ২৫ বছর ধরে একভাবে কাজ করছি। একটা ছবি নিয়ে পড়ে থাকি। মুক্তি পাওয়ার আগে পর্যন্ত পুরো টিমের সঙ্গে বসে ভাবি ছবিটা নিয়ে আর কী করা যায়। এটাই আমার প্র্যাকটিস হয়ে গিয়েছে। ঋতু বরাবরই মাল্টিটাস্কার। অনেক কিছু করে বেড়ায়। কিন্তু ক্যামেরার সামনে ও বরাবরই ফ্যান্টাস্টিক। অনেক কিছু একসঙ্গে করে। তাই কিছু জিনিস এদিক-ওদিক হয়। কিন্তু ক্যামেরার সামনে এসে যেটা দিচ্ছে, সেটা যদি পরিচালকের প্রত্যাশা ছাপিয়ে যেতে পারে, তাহলে বাকি সাত খুন মাফ! ঋতু অনেক কিছু একসঙ্গে হ্যান্ডেল করতে পারে, আমি পারি না। কোনওটাই কিন্তু ভুল বা ঠিক নয়। তবে একটা জিনিস বলব। টাইম ম্যানেজমেন্টটা যদি এ..এ..একটু ভাল করে করা যেত, তাহলে আরও ভাল হতো।
ঋতুপর্ণা: একটু!!
প্রসেনজিৎ: খবরের কাগজ তো। এর বেশি কিছু বলতে পারব না। (ঋতুপর্ণার সিগনেচার প্রাণখোলা হাসি)। এখন তো তা-ও যোগাযোগের মাধ্যম রয়েছে। অন্তত একটা হোয়াটস্‌অ্যাপ পেয়ে যাই যে আট মিনিট দেরি হচ্ছে। বুঝে যাই সেটা ১৮ মিনিট! কিংবা ওর টিম থেকে কেউ পৌঁছে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়... ‘দাদা..একটু বসে যান’। আগে তো বুঝতেই পারতাম না। বাড়ি থেকে বেরোলে আর ফোন নেই। আমি আমার সময়মতো পৌঁছে গিয়েছি। অথচ ওর পাত্তা নেই!

ওবেলা: পুরনো যে টেকনিশিয়ানরা আগে আপনাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, ফের আপনাদের একসঙ্গে দেখে তাঁদের কী রকম প্রতিক্রিয়া হয়?

প্রসেনজিৎ: ‘প্রাক্তন’এর অভিজ্ঞতাটা আমি বিশেষভাবে বলতে চাই। ওখানে যে ক্যামেরার টিম ছিল, তারা অনেক আগে থেকে আমাদের সঙ্গে কাজ করেছে। আমরা যখন নায়ক-নায়িকা, তারা তখন হয়তো ইলেকট্রিশিয়ান ছিল। আমাদের আবার একসঙ্গে দেখে তাদের প্রত্যেকের চোখে জল এসে গিয়েছিল। দে ওয়্যার ইন টিয়ার্স অফ হ্যাপিনেস। আরেকটা ঘটনা আমার মনে পড়ছে। মিসেস সেনকে সম্মান জানিয়ে একটা অনুষ্ঠান হয়েছিল। সেখানে আমরা পারফর্ম করিনি। কিন্তু একসঙ্গে মঞ্চে এসেছিলাম শেষে। কোনও রিহার্সাল ছিল না। ঋতু ঢুকল, আমিও ঢুকলাম। যতক্ষণ ছিলাম, সব টেকনিশিয়ানরা কাঁদছিল। এটা কিন্তু শুধু আমাদের স্টারডমের জন্য নয়। কারণ তারা আমাদের সত্যিই ভালবাসে।
ঋতুপর্ণা: ‘প্রাক্তন’এর প্রথম শটটা খাটের উপর ছিল। গুপিদা (গোপী ভগত, সিনেম্যাটোগ্রাফার) বলছিলেন, ‘মনে হচ্ছে না ‘উৎসব’এর শটটা। ঠিক যেন আগের দিনই শ্যুটিং করেছিলাম’!
প্রসেনজিৎ: আমি সব সময় মনে করি, টেকনিশিয়ানরাই আমাদের পেশায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ওরা যদি আমাদের ভাল না বাসে, পরিবারের মতো না মনে করে, তাহলে কোনও কিছুই সম্ভব হবে না।

ওবেলা: সময়ের সঙ্গে সব বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিকোণ বদলে যায়। এতগুলো বছরে আপনাদের একে অপরকে নিয়ে দৃষ্টিকোণ কতটা বদলাল?

ঋতুপর্ণা: কিছু কিছু বিষয়ে দৃষ্টিকোণ বদলে যায় ঠিকই, কিন্তু কিছু বিষয় বদলায় না। একটা মানুষের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক হলে, তার প্রতি দৃষ্টিকোণ যেটা তৈরি হয়ে যায়, সেটা কিন্তু একই রয়ে গিয়েছে। তবে কাজের ক্ষেত্রে অনেকটা বদলে গিয়েছে। অভিনেতা হিসেবে যে উত্তরণটা হয়েছে, সেটা নিয়ে জিগ্যেস করলে বলব অনেকটা মেটামরফোসিস হয়েছে। যাকে আমি একদম অন্যভাবে অভিনয় করতে দেখেছি, তার পরবর্তীকালে যখন অন্য রকম কাজ চোখে পড়েছে, ভাল-মন্দগুলো চোখে পড়েছে, তখন বুঝেছি, সেটা ধীরে ধীরে উদাহরণ দেওয়ার মতো জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে। তার ট্যালেন্ট সম্পর্কে আমার দৃষ্টিকোণটা বদলেছে। অভিনেতা হিসেবে আমার ওর প্রতি সম্মান বেড়েছে। মানুষ হিসেবেও ও আরও পরিণত হয়েছে। অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। এই জার্নিটার মধ্যে দিয়ে যেহেতু আমিও গিয়েছি, আমি নিজের সঙ্গে মেলাতে পারি। ওর অনেকগুলো কাজ আমার খুব ভাল লেগেছে। ‘দোসর’ যেমন আমার খুব প্রিয়। ওটা কিন্তু প্রথমে আমাকেই অফার করা হয়েছিল। পরে যখন ছবিটা দেখলাম, মনে হয়েছিল ছবিটা ব্রিলিয়ান্ট, ও ব্রিলিয়ান্ট। আমার করা হয়নি, তো কী হয়েছে! তারপর ‘বাইশে শ্রাবণ’ও দারুণ লেগেছিল। মনে হয়েছিল অভিনেতা হিসেবে ও অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে।
প্রসেনজিৎ: ঋতুর একটা জিনিস কিন্তু আমি চিরকালই দেখেছি। এবং সেটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটু একটু করে সেই দৃষ্টিকোণটা আরও গভীর হয়েছে। সেটা ওর একসঙ্গে অনেক কিছু করার ক্ষমতা। সকালে রিনাদি’র ‘পারমিতার একদিন’ করে এসে রাতে আমার সঙ্গে ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’ করছে। রিনাদি হয়তো জানেও না! সকালে আমরা একসঙ্গে ‘বাবা কেন চাকর’ করেছি, রাতে ‘উৎসব’! এই জার্নি দু’জনেই একসঙ্গে করেছি বলে অভিনেত্রী হিসেবে ওর প্রতি আমার একটা সম্মান ছিলই। এখনও রয়েছে। গত আট-দশ বছর ধরে ও যত ধরনের ছবি করছে, সব ছবির কথা বলছি না, কিন্তু ‘রাজকাহিনি’ বা ‘মুক্তধারা’র মতো কাজ দেখে আমার দারুণ লেগেছিল। ঋতুর অভিনয়ের উপর অসম্ভব দক্ষতা রয়েছে। সেটা যে ও সব সময় সঠিকভাবে ব্যবহার করে, তা নয়। আগেও আমার মনে হতো ও নিজেকে সব সময় ঠিকভাবে অ্যাসেস করে না, এখনও সেটা মনে হয়। কিন্তু যখন সেটা ঠিকমতো করে, ‘দহন’এর মতো ছবি তৈরি হয়! এমন অনেক বাণিজ্যিক ছবির কথা মনে আছে, যখন রিহার্সাল করতে এসে ঋতু এতটাই ক্লান্ত যে আমার পায়ের কাছে ঘুমিয়ে পড়েছে। শট রেডি হয়ে গেলে আমি আস্তে করে ওকে ডেকে বললাম, ঋতু, শট রে়ডি। ও উঠে যে-ই অভিনয়টা করল, কেউ জীবনেও ধরতে পারবে না, মেয়েটা ১৮ ঘণ্টা কাজ করছে! তাই ওর ক্ষমতার প্রতি আমার দৃষ্টিকোণ বরাবরই এক রকম। সেটা হঠাৎ করে একদিন ঘুম থেকে উঠে তৈরি হয়নি।