মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত লাগে, ধুর বাবা! লোকে শুধু ব্যোমকেশ নিয়েই কেন জিগ্যেস করছে

মাঝে মাঝে একটু বিরক্ত লাগে, ধুর বাবা! লোকে শুধু ব্যোমকেশ নিয়েই কেন জিগ্যেস করছে
ব্যোমকেশের ছায়া তাঁর পিছু ছাড়বে না। কিন্তু এই নিয়ে বেশি চিন্তা না করে তিনি চেষ্টা করেন নতুন ধরনের চরিত্র করে যাওয়ার। আবির চট্টোপাধ্যায়ের মুখোমুখি ‘ওবেলা’।

কেমন আছেন?
ঠিকঠাক। একটু দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। কিন্তু এই ব্যস্ততাটা যেন সব সময় থাকে।

সারাক্ষণ গোয়েন্দাগিরি করলে তো দৌড়াদৌড়ি করতেই হবে...।
এখানে (‘গুপ্তধনের সন্ধানে’) কিন্তু গোয়েন্দাগিরি করতে নামিনি। বরং‌ খুঁজতে বেরিয়েছি বলতে পারেন। গোয়েন্দাগিরির চেয়ে অ্যাডভেঞ্চার বেশি বলা যেতে পারে। সোনাদা ইতিহাসের অধ্যাপক। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরেছে। তার এক ভাইপো তার ভাইয়ের মতো। সেই ভাইপোর মামাবাড়ি গিয়ে নানা রকম ঘটনা ঘটে। আর গুপ্তধন মানে কিন্তু শুধু ঘড়া ভরা মোহর নয়। এর সঙ্গে ইতিহাসটাও অনেকটা জড়িয়ে আছে। সেই ইতিহাসটাই ওকে বেশি টানে। অনেকটা ড্যান ব্রাউনের রবার্ট ল্যাংডনের মতো বলতে পারেন, কিংবা নিকোলাস কেজের ‘ন্যাশনাল ট্রেজার’। তবে একটা বড় পার্থক্য আছে।

কী?
ওই গল্পগুলো বড্ড বিদেশি। এটা খাঁটি বাঙালি। গুপ্তধনের কথা আমরা গল্পের বইয়ে অনেক পড়েছি, কিন্তু সিনেমায় সেভাবে দেখিনি। রবার্ট ল্যাংডন খুবই জনপ্রিয় একটা চরিত্র। আমাদের মনে হয়েছিল ওই সময়ের ওই দেশের ইতিহাস নিয়ে পর পর এত লেখা যখন হতে পারে, তাহলে এদেশের ইতিহাস নিয়ে কেন হবে না। তাই মুঘল সাম্রাজ্যের সময়ে বাংলায় কী কী হয়েছিল, সেটা নিয়ে একটা গল্প লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাস পড়তে আমাদের অনেকেরই ভাল লাগত না। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা যখন সেসব জায়গায় বেড়াতে গিয়েছি, তখন ইতিহাসটা আরও বেশি ইন্টারেস্টিং লাগত। এই ছবির চিত্রনাট্য লেখার সময় সেটা মাথায় রাখা হয়েছিল।

আপনি খুবই সাবধানী। অনেক সময় এই ধরনের গল্প চিত্রনাট্যে দারুণ লাগলেও পরদায় সেভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না। সে ক্ষেত্রে নতুন পরিচালকের সঙ্গে কাজ করতে দ্বিধা হয়নি?
সাবধানী তো বটেই। অভিজ্ঞতা আমায় শিখিয়েছে চিত্রনাট্যের চেয়ে বড় হিরো আর কিছু নেই। সেটা যে কোনও ধরনের ছবিই হোক না কেন। বাণিজ্যিক, আরবান, ফেস্টিভ্যাল সার্কিটের জন্য তৈরি— যে কোনও ধরনের ছবিতে স্ক্রিপ্টটাই আসল। তাই চিত্রনাট্য বাছাই করার সময় আমি খুব খুঁতখুঁত করতে থাকি। এই ছবির চিত্রনাট্য আমার অনেক আগেই পড়া। কয়েকটা জিনিস খুব ভাল লেগেছিল। গোটা গল্প জুড়ে বাঙালিয়ানার ছোঁয়া রয়েছে। আরেকটা জিনিস হল, স্ক্রিপ্টটা লেখার সময় অনেক পড়াশোনা করা হয়েছে। কিন্তু সেগুলো কোথাওই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হয়নি। এটা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়। প্রথম যখন রামগোপাল বর্মা ছবি করা শুরু করেছিলেন, হাঁটুর তলা দিয়ে ক্যামেরা, চেয়ারের নীচ থেকে ক্যামেরা— মনে হচ্ছে বিশাল কিছু একটা হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো আসলে কোনও কাজে লাগে না। যত সহজ করে একটা জিনিস বলা হবে, তত সেটা গ্রহণযোগ্য হবে। সোনাদার চরিত্রটাও সেরকম। খুব সহজে অনেক কিছু গল্পের মতো বলে দিতে পারে। আরেকটা জিনিসও আমার ভাল লেগেছিল।

সেটা কী?
গোটা পরিবারের সঙ্গে উপভোগ করা যাবে, এই ধরনের ছবি একটু কম হয় এখানে। হয় ছবিগুলো একটু বেশি গম্ভীর হয়ে যায়, নয়তো একটু বেশি স্ল্যাপস্টিক হয়ে যায়। সব বয়সের দর্শকই ব্যোমকেশ দেখছেন। কিন্তু ১২-১৩ বছরের নীচে যারা, তারা মনে হয় না পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারে। এই ছবিটা কিন্তু তেমন নয়। বাচ্চারা তো উপভোগ করবেই। প্রাপ্তবয়স্করাও শৈশব ফিরে পাবেন।

এটা তো চিত্রনাট্যের কথা বলছেন। আসলে জিগ্যেস করছিলাম এগজিকিউশনের কথা...।
ধ্রুব’র (বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিচালক) কিছু বিজ্ঞাপনের কাজ আমি আগে দেখেছিলাম। ওর ভাবনা আর হাতে-কলমে সেই ভাবনাকে রূপ দেওয়া কিন্তু যথেষ্ট স্বচ্ছ। তার উপর টিমটা দেখেও মনে ভরসা ছিল। অরিন্দমদা (শীল) এটা প্রেজেন্ট করছেন, এসভিএফ এটার প্রযোজনার দায়িত্বে। ফলে আমায় শ্যুটিং শিডিউল, বা শ্যুটিং স্পটের ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলাদা করে ভাবতে হয়নি। এখানে ক্যামেরা করেছেন শমীক হালদার। শমীকদা বা শীর্ষদা (রায়) ক্যামেরার পিছনে থাকলে আমায় অনেক কিছু ভাবতেই হয় না। আমি জানি যেটা যেভাবে দেখানো দরকার, সেটাই হবে, তা নিয়ে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।

এই যে বার বার বলছেন ভাল টিম থাকলে অনেক কিছু ভাবতে হয় না, কিন্তু আপনি তো বড় ফ্র্যাঞ্চাইজি ছাড়াও বেশ কিছু ছবি করেন?
একটা বড় প্রযোজনা সংস্থার ছবি করলে প্রচারে কী কী হবে, সেটা ভাবার জন্য একটা টিম থাকে। আমায় মাথাই ঘামাতে হয় না। কিন্তু নতুন প্রযোজকের ক্ষেত্রে আমাকেই ভাবতে হয়, কী কী করা যেতে পারে। ‘আমি জয় চ্যাটার্জি’ করে এত ভাল ফিডব্যাক পেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা যেভাবে মুক্তি পাওয়া উচিত ছিল, সেটা পায়নি। এ ক্ষেত্রে প্রযোজকেরও কিছু করার থাকে না। সে-ও প্রথমবার কাজ করছে। করতে করতেই সকলে শেখে। তবে কিছু কিছু স্ক্রিপ্ট এতই পছন্দ হয়ে যায়, যে চরিত্রগুলো হাতছাড়া করতে ইচ্ছে করে না। মনে হয়, অভিনেতা হিসেবে সেটা আমার কাছে এতটাই বড় চ্যালেঞ্জ যে অভিনয় ছাড়াও আনুষঙ্গিক দিকগুলোর সঙ্গে ঠিক লড়ে নিতে পারব।

 বাজারে একটা ব্যোমকেশের সংখ্যা কমলো। নিশ্চিন্ত লাগছে?
ওরকম মনে হয়! কোনও নিশ্চয়তা নেই। হয়তো আবার একটা অন্য ব্যোমকেশ তৈরি হবে (হাসি...)।

আপনি নিজেই তো ‘বিদায় ব্যোমকেশ’এ অন্য রূপে।
ওই ছবিটা কিন্তু বাদবাকি ব্যোমকেশের চেয়ে অনেকটাই আলাদা। ওটায় আমায় দর্শক ব্যোমকেশ হিসেবে দেখতে পাবেন না।

এই যে বার বার অজিত বদলে যায়, পুরনো অজিতদের মিস্‌ করেন না?
প্রথম দিকে একটু খারাপ তো লাগেই। তবে একজন অভিনেতার পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে, তাঁর কোনও চরিত্র ভাল না লাগলে, সেটা ছেড়ে দেওয়ার। কারণ অনিচ্ছায় কাজটা করে গেলে, সেটা খুবই খারাপ হবে। এখন পরের ব্যোমকেশের কাজ সেভাবে শুরু হয়নি। তাই একবার পুরো প্রসেসটা শুরু হলে বুঝতে পারব, কী হতে চলেছে।

অরিন্দম শীল আর অঞ্জন দত্ত তো একসঙ্গে বসে সব ঝামেলা মিটিয়ে নিলেন। আপনার সঙ্গে অঞ্জন দত্তের ঝামেলাটা মিটল কি?
আমার সঙ্গে তো কখনও কোনও ঝামেলাই হয়নি (হাসি...)। অঞ্জনদা যে পরের ব্যোমকেশে অভিনয় করবেন, সেটা আগেই চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তারপর বাকিগুলো হল। সে সময় কথা হয়েছিল। কোনও রকম অস্বস্তি লাগেনি। শ্যুটিংয়ের সময় একটা কাজের মধ্যে থাকলে মনে হয় না আর কোনও অসুবিধে হবে। ওইটুকু ম্যাচিওরিটি আমাদের সকলেরই রয়েছে।

আপনি এত রকমের ছবি করেন, তা-ও ব্যোমকেশের ছায়া যেন আপনাকে ছাড়তেই চায় না।
আমি এত বড় এবং পরিচিত একটা ফ্র্যাঞ্চাইজির অংশ, যে এটা অবধারিত। আমি সৌমিত্রজেঠুকে নিজে বলতে শুনেছি এত রকম চরিত্র করার পরও লোকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বলতে এখনও ফেলুদাই ভাবেন! গত বছর আমি অনেক ধরনের ছবি করেছি। ‘আমি জয় চ্যাটার্জি’, ‘বিসর্জন’ ‘রুম নম্বর ৬০৯’, ‘তৃতীয় অধ্যায়’— সবই অন্য রকমের চরিত্র। আমি যে সারাক্ষণ অন্য রকম চরিত্রে কাজ করতেই থাকি, সেটা আমার কাছে স্বস্তির বিষয়। অস্বস্তির জায়গা হল, কিছু লোক আমি যা-ই করি, ব্যোমকেশ নিয়েই প্রশ্ন করেন। এই কিছুদিন আগে একটা ফেসবুক লাইভ করলাম, সেখানেও কিছু লোক ‘দাদা আপনার পরের ব্যোমকেশটা কবে আসবে’ মার্কা প্রশ্ন করতেই থাকে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এরা কি আদৌ ব্যোমকেশ ভালবাসে? বা আরও বড় প্রশ্ন হল, এরা কি আদৌ আমায় ভালবাসে? কারণ যাঁরা সত্যিই আমার কাজ ভালবাসেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে আমায় বলেছেন, ব্যোমকেশ থেকে বিরতি নিয়ে অন্য ছবি করে ভালই করেছেন। এই কথাগুলো আমায় অনুপ্রাণিত করে। এমন নয় যে আমি ব্যোমকেশের ছায়া নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত। তবে এটা ঠিক যে, অবচেতনে হয়তো এই চিন্তাটা কাজও করে। তাই আমি এত অন্য রকম চরিত্র করার চেষ্টা চালিয়ে যাই।


কখনও মনে হয় না এই কারণে যিশু-ঋত্বিকদের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন?
ওভাবে ভাবি না! ছবির যা হিসেব দিলাম, মনে তো হয় না আমি পিছিয়ে পড়ছি। চেষ্টা করি সবটাই পজিটিভলি নেওয়ার। তবে আমিও তো মানুষ, মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে যে, ‘ধুর বাবা, লোকে কেন শুধু ব্যোমকেশ নিয়েই জিগ্যেস করছে’। তবে চেষ্টা করি অন্য রকম চরিত্র করে যাওয়ার। অন্য ছবি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যদি দেখি একই ধাঁচের চরিত্র হয়ে যাচ্ছে, তখন করি না।


কোনও রকম প্রতিযোগিতা নেই বলছেন?
প্রতিযোগিতা যে রয়েছে, সেটা আমি কখনও অস্বীকার করিনি। তবে আমরা শত্রু নই। এই প্রতিযোগিতাটা দরকার। শুধু আমার জন্য নয়, সকলের জন্যই।

কাজের ফাঁকে কী করেন?
ছবি দেখি। ওয়েব সিরিজ দেখতে সুবিধা হয় এই সময়গুলোয়। কারণ ওয়েব সিরিজের নেশাটা ভয়ংকর। তবে বেশিরভাগ সময় ঘুমাই। বেড়াতে খুব একটা ভালবাসি না বলে সব সময় নালিশ শুনতে হয় বাড়িতে।

মেয়ে কি এখন বুঝতে পারে তার বাবা অভিনেতা? পরদায় দেখলে কীভাবে রিঅ্যাক্ট করে?
খুব একটা পাত্তা দেয় না। পরদায় আমায় খেয়াল করে। তবে এখনও পর্যন্ত রক্তমাংসের মানুষটাকেই বেশি পছন্দ করে দেখছি। একটা জিনিস দেখেছি, আমি টুপি পরলে খুব খুশি হয়ে যায়। কী জানি, 
বাবাকে টুপি পরাতে পারলেই বোধহয় ওর আনন্দ (হাসি...)।