শূন্য থেকে কোটিপতি শ্রীধাম বর্মণ

শূন্য থেকে কোটিপতি শ্রীধাম বর্মণ
মাছ চাষ বদলে দিয়েছে জলা, জাল আর ডিঙ্গি নৌকার জীবনমাঝি শ্রীধাম বর্মণের জীবন। শূন্য থেকে এখন তিনি কোটিপতি। আলো ঝলমলে তার চারপাশ। তাকে অনুসরণ করে এলাকার অনেক যুবকও পাচ্ছেন সাফল্য। অথচ এক সময় অভাব-অনটনই ছিল তার নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে তার বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছেন অনেক বেকার যুবক। সৃষ্টি হচ্ছেন নতুন নতুন চাষি ও উদ্যোক্তা।
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ভাষানিয়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামে শ্রীধাম বর্মণের জন্ম। বংশপরম্পরায় তিনি মৎস্য পেশায় জড়িত। জীবিকার তাগিদে ছোটবেলা থেকেই বাবা নিশিকান্ত বর্মণের সঙ্গে প্রতিদিন নদী, খাল-বিল আর হাওরের উন্মুক্ত জলাশয়ে মাছ শিকারে যেতে হতো তাকে। আর এখন তিনি পোনা উৎপাদন করে তা দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় রপ্তানি করছেন; আয় করছেন মুনাফা। পোনা উৎপাদন ও মাছ চাষে তার সহযোগী এবং বন্ধু চাষি হিসেবে কাজ করছেন অন্তত ৩০ জন। তিনি একাই বছরে ৭০ টন মাছ উৎপাদন করে উপজেলার মাছের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। অন্য চাষিদের কাছে তিনি আদর্শ।
পেছনের কথা : বছর ২৫ আগের কথা। ১৬-১৭ বছরের কিশোর শ্রীধাম। নিজস্ব জমি ছিল না। অর্থাভাবে অন্যের জমি কিংবা পুকুর লিজ নেওয়ার সাধ্যও ছিল না তার। কিন্তু স্বাবলম্বী হওয়ার আকাক্সক্ষা প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াত তাকে। ওই সময় স্থানীয় সাগর নামে এক ব্যক্তি দূর-দূরান্ত থেকে সামুদ্রিক পোনা এনে মাছ চাষ করতেন। শ্রীধাম সেই পুকুরে শ্রমিক হিসেবে শ্রম দিতেন। তিনি খেয়াল করতেন, কতটুকু জায়গায় কোন মাছের জন্য কীভাবে, কী খাদ্য, কী পরিমাণে প্রয়োগ করতে হয় ও কীভাবে পরিচর্যা নিতে হয়। সাগরের কাছ থেকে মাঝে মধ্যে পরামর্শ নিতেন। সাগরও তার সততা, নিষ্ঠা ও মাছ চাষের প্রতি আগ্রহ দেখে তাকে উৎসাহ, পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দেন। তারই পরামর্শে শ্রীধাম উপজেলা মৎস্য অফিসে যোগাযোগ করেন। মৎস্য কর্মকর্তাদের পরামর্শে একটি পুকুর করার চেষ্টা করেন। তার উদ্যম দেখে এগিয়ে আসে উপজেলা মৎস্য অফিস। তাকে প্রশিক্ষণসহ অল্প কিছু টাকা ঋণ দেওয়া হয়। সঙ্গে এনজিও থেকে আরও এক লাখ টাকা ঋণ নেন শ্রীধাম। তা দিয়েই প্রাথমিকভাবে একটি পুকুর পত্তন নিয়ে শুরু করেন মাছ চাষ। এর পর কেবলই শ্রীধামের এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি : এ প্রবাদটিকে জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে ধারণ করেন শ্রীধাম বর্মণ। মৎস্য অফিস আর এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের টাকায় ৯০ শতাংশ পরিমাণের একটি পুকুরে তেলাপিয়া চাষ শুরু করেন। প্রথম বছরেই লাভের মুখ দেখেন। পরবর্তীতে ১২০ ও ২০০ শতাংশের আরও দুটি পুকুর লিজ নিয়ে পোনা উৎপাদন ও মাছ চাষের আকার বৃদ্ধি করেন। লোকবলও বাড়ান। একে একে বর্তমানে নিজস্ব ও লিজে ২০টি পুকুর হয়েছে ৪২ বছর বয়সী শ্রীধাম বর্মণের। এগুলোতে চাষ করছেন রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, তেলাপিয়া, কার্প, পাবদা, গুলশা, সরপুঁটিসহ নানা জাতের মাছ।
নিজে লেখাপড়া করতে পারেননি শ্রীধাম বর্মণ, তবে ছোট এক ভাইকে এসএসসি পাস করিয়েছেন। আরেক ভাইকে সরকারি একটি হ্যাচারি থেকে মাছ চাষের ওপর প্রশিক্ষণ করিয়ে এনেছেন। শ্রীধামকে অনুসরণ করে সোহেল রানা, শফিক, হাসান, রফিক মিয়া, রতন চন্দ্র বর্মণ, মো. সোহেল মেম্বার, মো. নূরু মিয়াসহ আরও অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন।
মো. সোহেল রানা জানান, তিনি প্রথমে সন্দ্বীপে অন্যের পুকুরে ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করতেন। একদিন শ্রীধাম তাকে তার প্রজেক্টে চলে আসার আহ্বান জানান। কথামতো চলেও আসেন। শ্রীধামের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে মাছ চাষের কলাকৌশল শিখেন। এখন মৎস্য চাষ করে তিনি বেশ স্বাবলম্বী। মাসে ২০-৩০ হাজার টাকা পাওয়া যায় অনায়াসে।
আলাদা আলাদা প্রজেক্ট : শ্রীধাম বর্তমানে তিনটি পুকুরে চাষ করছেন পাঙ্গাশ মাছ। উপজেলা মৎস্য অফিসার বদিউল আলম সুফলের দেওয়া কারিগরি পরামর্শের ফলে প্রতিটি পুকুর থেকে গড়ে ১৫ টন করে ৪৫ টন মাছ উৎপাদন করতে পারছেন, যা আগে ১০-১১ টন ছিল। তেলাপিয়া, রুই, কাতল ও মৃগেল মাছ চাষ করছেন ১৪টি পুকুরে। যার প্রতিটি থেকে উৎপাদন হচ্ছে ২০ টন মাছ, যা আগে ছিল মাত্র ১২ টন।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা বদিউল আলম সুফল বলেন, উপজেলার সেরা চাষিদের মধ্যে শ্রীধাম বর্মণ অন্যতম। অত্যন্ত সংগ্রামী জীবন তার। তিনি একাই বছরে ৭০ টন মাছ উৎপাদন করে উপজেলার মাছের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। অন্য চাষিদের কাছে তিনি আদর্শ। উপজেলা মৎস্য অফিস থেকে ঋণ ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে একেবারে শূন্য থেকে যাত্রা শুরু করে এখন তিনি কোটিপতি।