নীল অঞ্জন ছায়ায়

নীল অঞ্জন ছায়ায়
নীল এবং অঞ্জন। লঞ্চ করলেন বিশেষ লাঞ্চ মেনুও। ছবি: সুপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়। লোকেশন সৌজন্যে: ইয়াওয়াৎচা, কোয়েস্ট মল

ওবেলা: দু’জনেই বোধহয় এতদিনে দু’জনের স্ট্রেংথ আর উইকনেসগুলো জেনে গিয়েছেন। এটা কি সুবিধার, না অসুবিধার?
অঞ্জন: আমার কাছে এটা একটা কোলাবরেশন। নীলের সেন্স অফ মেলোডি খুব স্ট্রং। আরও যার যার সঙ্গে কাজ করা যেতে পারে, তাদের চেয়ে। মেনস্ট্রিম ও আমার চেয়ে বেশি বোঝে। আমার মিউজিকটা এসেছে গায়ক-গীতিকারের ধারা থেকে। নীল জানে, কী করে পপুলিস্ট মিউজিক করতে হয়।
নীল: অনেকের সঙ্গেই কাজ করেছি, করছি। তবে শুরু বাবার সঙ্গেই। ’৯৩ থেকে একসঙ্গে গান গাইছি। আমি বাজাতাম, বাবা গাইত। আমি জানি, বাবা কী চায়। জানি, গানগুলো ব্যালাড হবে এবং কথাগুলো খুব সহজ। জানা জায়গা থেকে নতুন কিছু দেওয়ার চেষ্টা থাকে বরাবর।

ওবেলা: ইতিমধ্যেই ছবির মিউজিক হিট। জানেনই যখন কী চান, তাহলে দু’জনে এতটা সময় নিলেন কেন একটা মিউজিক্যাল করতে? 
অঞ্জন: আসলে এমন কিছু সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম, যেখানে গান আর ইম্পর্ট্যান্ট থাকেনি। ‘বং কানেকশন’, ‘চলো লেটস গো’, ‘ম্যাডলি বাঙালি’,‘রঞ্জনা...’, এই চারটে ছবিতেই চরিত্রগুলো যাকে কেন্দ্র করে আছে, তারা গান করে। কিন্তু ‘রঞ্জনা...’র পর থেকে সেটা হয়নি। (একটু থেমে) হ্যাঁ, বলতে পারেন, ব্যোমকেশ খুবই সফল। 


ওবেলা: কিন্তু সেটা তো ছাড়লেন নিজের পুরনো জঁরে ফিরবেন বলে...।
অঞ্জন: একদম প্রথমে যারা আমার ছবি দেখতে এগিয়ে এসেছিল, তারা মূলত আমার গানের দর্শক। আমার অভিনয় বা টেলিফিল্মের দর্শক নয়। ব্যোমকেশে অনেক বেশি মেনস্ট্রিম দর্শকের কাছে আমি পৌঁছলাম। গান তৈরির টেনশনটা ছিল না। সমকালীন জীবনবোধ নিয়ে আমার যে ভাল লাগার জায়গাটা, তা তো ষাটের দশকের নয়। মনে হচ্ছিল, হঠাৎ সেটা নিয়ে কেন মাথা ঘামাচ্ছি। ‘আমি আসব ফিরে’তে  গান যারা শুনছে, তারা খুূব গুরুত্বপূর্ণ। গান কীভাবে আক্ষরিক অর্থে তাদের জীবনটা বদলে দিচ্ছে, সেটাও।

ওবেলা: গান সত্যিই মানুষের জীবন বদলাতে পারে?
অঞ্জন: পারে। যেভাবে সিনেমা পারে, গল্পের বই পারে। বন্ধুত্ব হয়েছে দু’জনের আমার গান শুনে। বিচ্ছেদ হয়েছে। নেশা ছেড়ে দিয়েছে। অনেকের ছোটবেলা কেটেছে আমার গান শুনে। সেই জায়গা থেকেই এই গল্পটা। অন্য অনেকের মতো ছবি করছিলাম এতদিন, অন্য আরেক জন যেটা পারে সেটা। সরে এসে এবার আমি যেটা পারি, সেটাই করলাম।

ওবেলা: নীল, বাবা যে নিজের মতো ছবিগুলো করতে পারছিলেন না, সেটা দেখে কি আপনারও কোথাও কষ্ট হতো?
নীল: বুঝতে পারছিলাম, একটা কিছু বদল হয়েছে। একটা সময় হয়তো বাবার মনে হয়েছে, মিউজিক্যাল থেকে বেরিয়ে একটা থ্রিলার করার। তার পর যে কোনও কারণে থ্রিলারটা পপুলার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়ে বাবা একটা ‘শেষ বলে কিছু নেই’, একটা ‘হেমন্ত’ করারও চেষ্টা করেছে। কোনও কারণে সেগুলো সফল হয়নি। এই প্রসেসটার মধ্যে আমিও তো ছিলাম। 
অঞ্জন: কোনও প্রোডিউসার ইন্টারেস্টেড হচ্ছিল না। যাঁরা টাকা ঢালবেন, তাঁরা বরঞ্চ আমার ব্যোমকেশে বেশি আগ্রহী ছিলেন। আলাদা করে আমার গানের প্রতি প্রোডিউসারের আগ্রহ ছিল বলে আমার মনে হয় না। 
নীল: বাবার পরিচয়টা হয়ে গেল ‘ব্যোমকেশের পরিচালক’!
অঞ্জন: অথচ আমি গান গেয়ে নাম করেছি।

ওবেলা: অঞ্জনের একটা বিখ্যাত উক্তি, ‘অভিনেতা হতে চেয়েছিলাম, গায়ক হয়ে গিয়েছি’। নীল, আপনার কী মত?
নীল: (মুচকি হেসে) গান বাবা নিশ্চয়ই ভালবাসত। তবে গানটা যে পেশাদারিভাবে করবে, সেটা কেউই বুঝতে পারিনি। আমি যখন জন্মেছি, বাবা তো একজন অভিনেতাই। সেখান থেকে সিনেমা বানানো, প্রযোজনা করা, ডকুমেন্টরি বানানো, সিরিয়াল করার দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে অভিনয়টা তো থেকেই গিয়েছে। জানি না, গানটা অ্যাক্সিডেন্টালি ঘটে গিয়েছিল কি না। তবে এটা ঠিক, বাবার গায়ক হয়ে যাওয়াটা আমাদের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। বাট দ্যাট বিকেম দ্য মোস্ট পপুলার ফেনোমেনন। 

ওবেলা: অঞ্জন, আপনিই বা এই কথাটা কেন বার বার বলেন? 
অঞ্জন: আমার যে ছবিগুলো রিলিজ করেছিল, প্রত্যেকটা কমার্শিয়ালি ফ্লপ। ‘চালচিত্র’ রিলিজ করেনি। ‘খারিজ’ চলেনি। ‘মহাপৃথিবী’ও তাই। ‘অন্তরীন’ও। ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘শিল্পী’, যা যা আমি করেছি, সব ডিজাস্টার। অথচ বার্লিনে যাচ্ছে, আর্ট সিনেমা হিসেবে প্রশংসিত হচ্ছে। মৃণালদা আর আমি হল’এর বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। আমাকে পোস্টারে দেখে বলছে, ‘লোকটা কে? কে রে ছেলেটা’! আশির দশকে যাঁরা সিনেমা বানাচ্ছিলেন, অভিনেতা হিসেবে তাঁরা কিন্তু আমাকে সিরিয়াসলি নেননি। আমার মনে হয়েছিল যে, আমি সৌমিত্রের পরের জায়গাটায় আসতে পারব। আজ সৃজিত, মৈনাক, বিরসা, প্রতিম দাশগুপ্ত, অরিন্দম শীল যেভাবে কাস্টিং করছে, আগে তা সম্ভব ছিল না। এই যে নতুনদের থিয়েটার বা টেলিভিশন থেকে এনে কাস্ট করা, সেটা না থাকায় আমার মতো একটা গোটা প্রজন্ম হয়তো অভিনেতা হিসেবে হারিয়ে গিয়েছে। সেজন্য গান করতে চলে গেলাম। কিন্তু যেহেতু আবার সিনেমাও করতে চাই, ফিরে গিয়েছি ডিরেকশনে।

ওবেলা: মানে আপনার ক্রেজ ছিল না বলছেন?
অঞ্জন: যাঁরা স্বীকৃতি পেয়েছিলেন তাঁদের নিয়ে ছিল। আমাকে নিয়ে নয়। 



নীল এবং অঞ্জন। ছবি: সুপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়

ওবেলা: নীল, আপনার কী মত?
অঞ্জন: আমার মনে হয় না, খুব ছোটবেলায় নীল আমাকে অটোগ্রাফ দিতে দেখেছে। বরং বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, মৃণাল সেনের মতো বুদ্ধিমান লোকজনকে দেখেছে। খুব বেশি তখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সঙ্গে মিশতে দেখেনি। বড় জোর মমতাশংকর বা ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্যের লোকেরা, থিয়েটারের লোকেরা অনেক বেশি আসত বাড়িতে। নীল আমার স্টারডমটা দেখেছে ’৯৪ থেকে। যখন ও পরিণত হয়ে গেল।
নীল: ছোটবেলায় তো অতটা বুঝতামও না মৃণাল সেন কে, উৎপল দত্ত কত বড় স্টার। আমার কাছে কখনওই এটা ম্যাটার করেনি। 
অঞ্জন: ফেম, সাকসেস, মানি অনেক পরে এসেছে আমাদের দু’জনেরই জীবনে। নব্বইয়ের দশকে হয়তো বাড়ি কেনা হয়েছে, গাড়ি কেনা হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত নীল আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই ছিল। আই ওয়াজ লাইক এনি আদার পার্সন। কিন্তু সারা পৃথিবীতে কী ঘটছে, সেটা জানার আগ্রহ ছিল ওর মধ্যে। 


ওবেলা: নীল, অঞ্জন দত্ত আপনাকে কতটা প্রভাবিত করেছেন? 
নীল: অঞ্জন দত্ত আর্টের পৃথিবীর দরজাটা আমার সামনে খুলে দিয়েছিল। সেটা গান হতে পারে, কবিতা হতে পারে, কোনও শিল্পী হতে পারেন। অঞ্জন দত্তের মাধ্যমেই আমি মৃণাল সেনকে চিনেছি। অঞ্জন দত্তর মাধ্যমে অজস্র বই বাড়িতে পেয়েছি। অঞ্জন দত্তের জন্য গিটার বাড়িতে রয়েছে। একজন অভিনেতাকে নিয়ে আলোচনা করা, ভাল অভিনেতা কারা, কী রকম গান শোনা উচিত— অঞ্জন দত্ত কিন্তু আমাকে কোনওদিনই সরাসরিভাবে এগুলো বলে দেয়নি। ইট ওয়াজ দেয়ার। আমি বেছে নিয়েছি এত কিছুর থেকে। অবশ্য বাছা আর কী করে বলি, সবই তো ভাল ছিল! 

ওবেলা: সত্যি বলবেন, বাবা কোন ছবিটা সবচেয়ে খারাপ বানিয়েছেন?
নীল: ‘গণেশ টকিজ’! কেন যে বানিয়েছিল কে জানে (হেসে উঠলেন বাবা-ছেলে)!