হোঁচট খাচ্ছে গণতন্ত্র, আসেনি মুক্তি

হোঁচট খাচ্ছে গণতন্ত্র, আসেনি মুক্তি
বিশ্বের নবীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মিয়ানমার। যদিও গণতন্ত্রে উত্তরণে দীর্ঘ সংগ্রামের পরও দেশটিতে প্রকৃত গণতন্ত্র এখনো আসেনি বলে মনে করতেন উইন টিন। যিনি সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। দুই দশক কারাগারে থেকে মুক্তির পরও মুক্ত ভাবেননি নিজেকে। যিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ অং সান সু চির সাথে ১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দীর্ঘ কারাজীবনের অমানুষিক নির্যাতনও আন্দোলনের পথ থেকে সরাতে পারেনি টিনকে, কারাবন্দীদের নীল জামা পরেই চিরবিদায় নিয়েছেন তিনি। ২০১১ সালে ইয়াঙ্গুনের ‘ইনসেইন’ কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও মনে করেননি গণতন্ত্রকামীদের মিয়ানমারে এখনো স্বাভাবিকভাবে মূলধারার রাজনীতি শুরু করার সময় এসেছে।

কিন্তু সু চি গণতন্ত্রকে মুক্ত করার আন্দোলনে জীবন্ত কিংবদন্তি হয়েও পরে বিতর্কিত হয়েছেন। ১৯৮৯ সালে সামরিক সরকার সু চিকে গৃহবন্দী করেছিল। ২০১০ সালে গৃহবন্দী থেকে গণতন্ত্রপন্থী এ নেত্রীকে মুক্তি দেয়ার মাধ্যমে দেশটিতে গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে সামরিক জান্তা। প্রায় অর্ধশতকের সেনা শাসনের অবসান ঘটিয়ে ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে এনএলডি। সংবিধানের ৫৯ (এফ) ধারায় বলা আছে, ‘কোনো নাগরিক বিদেশীকে বিয়ে করলে তিনি মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’ এ কারণে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ না থাকায় এনএলডির জ্যেষ্ঠ নেতা টিন কিয়াও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। টিন কিয়াউ সু চির মায়ের নামে পরিচালিত একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন, তার স্ত্রী এনএলডির একজন এমপি এবং তার শ্বশুর এনএলডির কো-ফাউন্ডার ছিলেন।

অসুস্থতার কারণে টিন পদত্যাগ করলে সু চির ঘনিষ্ঠ মিত্র, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও একসাথে কারাবন্দী থাকা নেতা উইন মিন্টকে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে পার্লামেন্ট। টিন কিংবা মিন্ট আলঙ্কারিক রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বই পালন করেন, কার্যত সরকার পরিচালনা করেন বিদেশ মন্ত্রী এবং স্টেট কাউন্সিলর সু চি। এখন তো নোবেলজয়ী পরিচয় ছাপিয়ে ‘গণহত্যার সহযোগী’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠছেন তিনি। মিয়ানমারবাসী ভেবেছিলেন, সামরিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে এনএলডি ক্ষমতায় আসলে দেশের পরিস্থিতি আমূল বদলে যাবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারবে। কিন্তু পরিস্থিতি এতটাই উল্টো দিকে মোড় নিয়েছে যে বিকাশমান গণতন্ত্রই প্রশ্নের মুখে! দুই বছর সু চির ভূমিকা ও বক্তব্য খেয়াল করলে দেখবেন তিনি সেনাবাহিনীবিরোধী কোনো বক্তব্য দেননি। উগ্রপন্থী বৌদ্ধদের মিয়ানমারকে বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাওয়ার প্রক্রিয়ার বাইরে নন সু চি। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। তবুও দেশটির অনেক মানুষের সমর্থন এখনো সু চি ও তার সরকারের প্রতি রয়েছে।

মিয়ানমারের ক্ষমতার কেন্দ্রে দেশটির সেনাবাহিনীর অবস্থান এখনো বেশ শক্তপোক্ত। সু চি মিয়ানমারের মূল খেলোয়াড় নন। সেনাবাহিনীর কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে দেশটির শান্তি ও গণতান্ত্রিকপ্রক্রিয়া পুরোপুরি ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় আছেন তিনি। সংবিধান মোতাবেক সেনাপ্রধান নিজেই নিজের প্রতি দায়বদ্ধ, কার্যত স্টেট কাউন্সিলর কিংবা প্রেসিডেন্টের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। সেনাপ্রধান কিছু ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের ওপরও হস্তক্ষেপ করতে পারেন। সংসদের উভয় কক্ষে সেনাবাহিনী থেকে আসা প্রার্থীদের মনোনয়ন করার ক্ষমতা সেনাপ্রধানকে দেয়া হয়েছে। ৬৬৪ সদস্যের সংসদে ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রয়েছে। পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র এবং সীমান্ত মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পুলিশের নিয়ন্ত্রণও সেনাবাহিনীর হাতে ন্যস্ত। মিয়ানমারের শাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত এবং সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অনুমোদনের প্রয়োজন হয়।

গণতন্ত্রের পথে চলা শুরুর দুই বছর পরও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণের ভোগান্তি পোহাচ্ছে জনগণ। বাড়ছে বিভিন্ন রাজ্যে অস্থিতিশীলতা, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ, গণতান্ত্রিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-দলে শূন্যতা তৈরির আশঙ্কা এবং সেনাবাহিনী ও তাদের মিত্রদেরই অবশিষ্ট থাকার সম্ভাবনা। নির্বাচনে ৮০ শতাংশ ভোট পেলেও সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই চলতে হচ্ছে এনএলডিকে। পার্লামেন্টের ১৬৬ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকায় সেনাবাহিনীর সমঝোতার ওপরই নির্ভর করছে মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্র’। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে এনএলডি নিরঙ্কুশ বিজয় পেলেও নির্বাচনের পরই তা প্রত্যাখ্যান করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এখনো মিয়ানমারে গণতন্ত্র বেশি দূর এগোতে পারেনি।

সু চির মিত্রদেশ যুক্তরাজ্যের কিংবা সু চির উপদেষ্টা দলের মধ্য থেকে আসা নীতিবিষয়ক ঘোষণাগুলোতে সরকার পুরো মাত্রায় কর্তৃত্ববাদী এটা স্পষ্ট, গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটাও নেই। হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগে বহু রোহিঙ্গা মুসলিমের হতাহতের ঘটনাগুলোকে শুরুতে উপেক্ষার চেষ্টা করেন সু চি। এ কারণে তিনি আন্তর্জাতিক মহলে নিন্দিতও হন। রোহিঙ্গাদের আদি নিবাস রাখাইনে জাতি নিধন চলে। সামরিক বাহিনীর সাথে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ান সু চিও। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি এবং চাকরির অধিকার নেই। এছাড়া দেশটিকে দারিদ্র্য আঁকড়ে রেখেছে আগে থেকেই।

পশ্চিমা দেশ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে অং সান সু চি ছিলেন একবিংশ শতাব্দীর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক। রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন এবং বাড়িঘরে অগ্নি সংযোগের পর তিনি বিতর্কিত ও নিন্দিত হয়েছেন। পশ্চিমা দুনিয়া, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন সু চির সমালোচনা করছেন।

যা হোক, আশা-নিরাশার দোলাচালে মিয়ানমারের জনগণ। যখন সেনাশাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছে তখন মিয়ানমারের জনগণ জানত তারা কী চান। কিন্তু এখন তারা জানে না তারা কী চায়। অস্পষ্টতা ও বিভ্রান্তিতে ভরা প্রশাসন। মানুষের পাহাড়সম প্রত্যাশা পূরণে কমই সাফল্য পেয়েছে সু চি। এ অবস্থায় এনএলডিকে সঠিক লোক বাছাই করে সঠিক স্থানে বসাতে হবে এবং সরকারের দক্ষতা বাড়িয়ে ধোঁয়াশামুক্ত ‘কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্রের নতুন যুগে গণতন্ত্রের দীর্ঘদিনের সঙ্কট নতুন মাত্রা পেলে অর্থবহ গণতন্ত্র হবে না। দেশটির জনগণ চায় সামরিক শাসনের যাঁতাকলে স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, জাতিগত সঙ্ঘাত সমাধানসহ শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হোক।