রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে খেলছেন বাশার

রাসায়নিক অস্ত্র নিয়ে খেলছেন বাশার
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচণ্ড আঘাত হানার মাধ্যমে প্রভাব বিস্তার করে শিরোনাম হওয়ার সামর্থ্য আছে। এমনকি কয়েক দিন আগে তিনি যেভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেভাবে সিরিয়ায় বিমান হামলা চালালেও সহজেই তিনি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হবেন; কিন্তু দীর্ঘ অভিযান শুরু করার ব্যাপারে তার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। গত সপ্তাহের রাসায়নিক হামলার ব্যাপারে তিনি দুঃখ প্রকাশ করতে পারেন বলে আশা করা যায়। এ জন্য হয়তো তিনি কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ফিরে আসতে পারেন।

পূর্ব গৌতার দুমায় এক সপ্তাহ আগে সর্বশেষ হামলার আগে যেভাবেই হোক না কেন, এটাই ছিল সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের হিসাব। পূর্ব গৌতায় সর্বশেষ রাসায়নিক হামলা চালিয়েছেন বাশার আল আসাদ। ওই সময় এই নিষ্ঠুরতাকে বিস্ময়করভাবে এবং সাথে সাথে আতঙ্কগ্রস্তভাবে স্বাগত জানানো হলো। ট্রাম্প সম্প্রতি কেবল সিরিয়া থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুতরাং বাশার মার্কিন সৈন্যদের ফিরিয়ে আনার মতো কোনো কিছু কেন করবেন? আমেরিকা যখন পশ্চাৎপসরণ করছে, তখন দুই দেশের বিরোধ কেন ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা হবে না? ক্লোরিন গ্যাসের যেকোনো ব্যবহার নিঃসন্দেহে ট্রাম্পকে উত্তেজিত তথা হামলা চালাতে প্ররোচিত করবে। কারণ তিনি নিজেকে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার বিরোধী হিসেবে মনে করেন। চার বছর আগে যখন রাসায়নিক বোমা হামলায় দামেস্কে এক হাজার ৪০০ লোক নিহত হয়েছিল, তখন ওবামা ওই হামলার জবাব দিতে ব্যর্থ। তাই ট্রাম্পের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল দ্রুত এবং বলিষ্ঠ প্রতিশোধ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি। আচরণগত দিক দিয়ে এটা হচ্ছে একটি সুন্দর ও মানসম্মত অবস্থান। তিনি চ্যালেঞ্জ অনুভব করলে জবাব দেবেন। গত বছর সিরিয়ার একটি সামরিক হামলার বিরুদ্ধে শাস্তি দেয়ার পর এখনো একই ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ ব্যতীত তার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না। ফ্রান্স থেকে সৌদি আরব- তার মিত্রদেরও একই ধরনের ইচ্ছা বা অভিমত। বাশার আল আসাদের কৌশলকে পাগলামি বা চরম বোকামি হিসেবে দেখা যেতে পারে। ট্রাম্প ‘প্রচণ্ড আঘাত’ হানা হবে বলে কী বুঝাতে চেয়েছেন তা বাস্তবে না দেখা পর্যন্ত তিনি কী করবেন, তা স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ একসময় আবেগের মাত্রাতিরিক্ত প্রাবল্য প্রকাশ করেছিলেন। মৌখিকভাবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য সামরিক বাহিনী সেখানে ছিল না। তিনি বলেছিলেন কোনো প্রেসিডেন্ট না ‘২ মিলিয়ন ডলারের একটি ক্ষেপণাস্ত্র ১০ ডলারের একটি খালি তাঁবুর’ ওপর নিক্ষেপ করতে প্রস্তুতি নেয়া উচিত নয়। হামলা করলে অবশ্যই ‘দৃঢ় সিদ্ধান্ত’ নিয়ে তা করতে হবে।

আল আসাদ যখন গত বছর সরকারবিরোধী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত, খান শেইখু শহরে সারিন গ্যাস নিক্ষেপ করেছিলেন, তখন ট্রাম্প আল শাইরাত বিমান ক্ষেত্রে ১০০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন। আল আসাদ যেখান থেকে হামলা চালিয়েছিলেন- একই স্থান থেকেই ট্রাম্প ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এটা ছিল ব্যয়বহুল; কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ভেবে-চিন্তে দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে ওই হামলা চালানো হয়নি। ওই ৫৫টি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে কয়েকটি হাঙ্গার এবং প্রায় ২০টি এয়ারক্রাফট ধ্বংস করে দেয়া হয়; কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই টারমাক মেরামত করে নেয়া হলো। আর দিনের শেষে সিরিয়ার যুদ্ধবিমানগুলো একই বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করে একই বিদ্রোহীদের ওপর বোমাবর্ষণ করেছে। বাশার আল আসাদ আমেরিকার প্রেসিডেন্টের প্রচণ্ড ক্রোধ উপলব্ধি করতে পারেন- এটা একটা বিপর্যয় হলেও খুব মারাত্মক ছিল না।

তাই ভয় দেখিয়ে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার থেকে নিবৃত্ত করার চেয়ে গত বছর ট্রাম্প যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, তাতে বরং বাশার আরো উৎসাহিত হয়েছিলেন। নতুন একটি নজির স্থাপিত হয়। বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করা হলেও দোষী পক্ষ এবং তাদের সমর্থকেরা সহজেই তা অস্বীকার করতে পারে। পশ্চিমা শক্তি মৌখিকভাবে হামলার দৃঢ় জবাব দেয়ার কথা বললেও সামরিক দিক দিয়ে তারা শিথিল প্রতিক্রিয়া দেখাবে। জাতিসঙ্ঘ হিসাব করেছে, আল আসাদ কমপক্ষে চারটিরও বেশি রাসায়নিক হামলা চালিয়েছেন। অথচ প্রত্যেকটি হামলার পরই সিরিয়া এবং রাশিয়া এই হামলা চালানোর বিষয় অস্বীকার করে আসছে। সবচেয়ে খারাপ হলো- এ ধরনের অস্ত্র অত্যন্ত মারাত্মক, এগুলো নিশ্চিতভাবে ক্ষতি করে থাকে। আল আসাদের সর্বশেষ টার্গেট হলো জাইশ আল-ইসলামের বিদ্রোহীরা। এই যোদ্ধারা ঘেরাও, মর্টার হামলা এবং বোমা হামলা মোকাবেলা করেও টিকে রয়েছে। রাশিয়ানরা তাদের সাথে আলোচনা শুরু করেছে; কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। গত সপ্তাহের হামলার পর সব কিছু বদলে গেছে।

বিদ্রোহীরা সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে নিরাপদ স্থানে ফিরে যাওয়ার শর্তে তাদের বর্তমান অবস্থান থেকে সরে যেতে সম্মত হয়েছেন। তাদের হটে যাওয়ার প্রক্রিয়া এখন চলমান । ৮ হাজার যোদ্ধা এবং ৪০ হাজার বেসামরিক লোক এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। মিডিয়া জানিয়েছে, বিদ্রোহীরা তাদের হাতে আটক থাকা বন্দীদের ছেড়ে দিচ্ছে। সুতরাং সামরিক দিক দিয়ে এতে বাশার আল আসাদের জন্য সুবিধা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাশারের প্রতি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জন্য প্রস্তুত থাকতে টুইটারে আহ্বান জানানোর পর আমরা আরো ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আশঙ্কা করতে পারি। নতুন এবং স্মার্ট ক্ষেপণাস্ত্র হামলা আসছে বলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার টুইটার বার্তায় উল্লেখ করেছেন; কিন্তু আল আসাদ এই বার্তার সত্যতা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছেন। তিনি এখনই বিদ্রোহীদের ছত্রভঙ্গ করতে চান না, তবে তিনি তার বেঁচে যাওয়া শত্রুদের জানাতে চান যে, তিনি বিষাক্ত গ্যাস হামলায় আক্রান্ত তাদের শিশুদের দেখতে প্রস্তুত থাকবেন। আমেরিকার স্যাটেলাইট ছবির সুবিধার্থে কয়েকটি রানওয়েকে ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে; কিন্তু আল আসাদ হয়তো এখনো রাশিয়ান এবং ইরানিদের সাথে তার তৎপরতা চালিয়ে যাবেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার পক্ষ থেকে কেবল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে একজন মক্কেল পাওয়ার জন্য নয়, বরং আমেরিকার বিরুদ্ধে একটি অবস্থান গ্রহণের জন্যই গোটা উপাখ্যানকে ব্যবহার করবেন। খুব বেশি দিন আগে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়নি। এই অস্ত্র ব্যবহার করাটা হচ্ছে একটা রেড লাইন। এটি অতিক্রম করলে আগ্রাসী শক্তির জন্য ফলাফল অত্যন্ত ধ্বংসাত্মক হতে পারে; কিন্তু সিরিয়ায় সমঝোতা শেষ হয়ে গেছে। ওই সব বোমা হামলায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। এর মাধ্যমে পশ্চিমারা সত্যিই কত ক্ষতি করেছে সেটাই দেখানো হচ্ছে।

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন পাঁচ বছর আগে সিরিয়ায় হামলার ব্যাপারে পার্লামেন্টের ভোটাভুটিতে হেরে গিয়েছিলেন। আর বর্তমান প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে সম্ভবত ভোটের কোনো তারিখ নির্ধারণ করবেন না। ফ্রান্স আমেরিকার নেতৃত্বে তাদের কিছু ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাবে; কিন্তু আল আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার ব্যাপারে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি।

দায়েশ তথা ইসলামিক স্টেটকে ধ্বংস করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে ট্রাম্প প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি সিরিয়ায় মার্কিন সৈন্যদের মেয়াদ হ্রাস করে তাদের সহায়তা করছেন। সাধারণভাবে সামরিক বাহিনীকে কম ব্যবহার করার প্রতি তার ঝোঁক বেশি। সে কারণেই তিনি এক সপ্তাহ আগে সিরিয়া থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনার কথা বলেছিলেন। তিনি এর ফলাফল দেখতে চান।

ট্রাম্প বলেছিলেন, তার কাছে উত্তর কোরিয়ার একনায়ক কিম জং উনের চেয়েও ‘অনেক বড় এবং অধিক শক্তিশালী’ পরমাণু বোতাম রয়েছে। তার এই বক্তব্যের জন্য মানুষ তাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিল। তবে তিনি বলেছেন, কিম আলোচনার টেবিলে বসতে সম্মত হওয়ায় তার সাথে বিরোধের অবসান ঘটেছে। চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধের হুমকি দেয়ার জন্যও ট্রাম্পের পক্ষ থেকে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে; কিন্তু তিনি চলতি সপ্তাহের প্রথমার্থে আমেরিকান মোটর গাড়ির ওপর থেকে কর হ্রাসের কারণে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রস্তাবে সত্যতা দেখছেন।

সুতরাং ট্রাম্পকে যুদ্ধবাজ হিসেবে চিহ্নিত করাটা কঠিন। তবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার ব্যাপারে তার প্রবল আকাক্সক্ষা আছে। ওবামার মতোই তিনিও রাসায়নিক অস্ত্রের ওপর বিশ্বব্যাপী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তার প্রচণ্ড ক্ষোভ ও উত্তেজনা হয়তো একদিন বা এক সপ্তাহ স্থায়ী হতে পারে। এরপর তিনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবেন। আর আল আসাদকে চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত খেলার জন্য ছেড়ে দেয়া হবে।

লেখক : দি স্পেকটেটরের সম্পাদক এবং ডেইলি টেলিগ্রাফের কলামিস্ট
লন্ডনের দি ডেইলি টেলিগ্রাফ থেকে