ফেসবুক স্ক্যান্ডাল কী বার্তা দিলো?
ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্রিটিশ তথ্যবিষয়ক একটি কোম্পানিকে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ফেসবুক ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের অনুমতি দেয়ার বিষয় ফাঁস হওয়ার পরই এ নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে সমালোচনা। অভিযোগ উঠেছে, এসব তথ্য পরবর্তীকালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ইউরোপ থেকে যুক্তরাজ্যের বের হয়ে যাওয়া বা ব্রেক্সিট-বিষয়ক গণভোটে সাধারণ মানুষের মতামতকে প্রভাবিত করতে ব্যবহার করা হয়েছে। এটি ব্যক্তিগত গোপনীয়তার বিষয়ে হস্তক্ষেপই শুধু নয়, বরং বিরক্তিকরভাবে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা। এমন প্রক্রিয়ায় তথ্য ফাঁস বন্ধ করা না গেলে এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে।
উইকিলিকস-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ একসময় ফেসবুককে বলেছিলেন ইতিহাসের ‘সবচেয়ে মনোযোগ আকর্ষণকারী নজরদারি যন্ত্র’। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রতি মাসে ২.২ বিলিয়ন ব্যবহারকারী ফেসবুকে সক্রিয় থাকেন, এ তথ্য জানার পর যে-কেউ অ্যাসাঞ্জের এই মন্তব্যকে স্বাগত জানাতে পারেন।
এ ঘটনার পর ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ব্যবহারকারীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে এবং ভবিষ্যতে ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার ব্যাপারে আরো সতর্ক হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে পশ্চিমা বিশ্বজুড়ে ফেসবুক বর্জনের ডাক দেয়ার পরও এটি বিশ্বাস করা কঠিন যে, এই স্ক্যান্ডালের কারণে ফেসবুক বন্ধ হয়ে যাবে বা এর পতন হবে।
ফেসবুকের বিরুদ্ধে আরো একটি অভিযোগ, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এর ব্যবহারকারীদের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে, ফোনকল পর্যবেক্ষণ করে এবং অতীত ফোনকলের বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে। স্পষ্টভাবেই বলা যায়, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের এমন নজির শুধু ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ নয়; অন্যান্য প্ল্যাটফরমও ব্যবহারকারীর তথ্য অন্যায়ভাবে সংগ্রহ করে, অনুসরণ করে এবং বিক্রিও করে। এমন তথ্য এখন প্রকাশ্য গোপনীয় ব্যাপার। তবে এটা প্রমাণিত যে, ফেসবুক ব্যবহারকারীদের তথ্য ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা নামে একটি প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করেছে এবং ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় তা ব্যবহার করা হয়েছে।
নতুন এই তথ্য আসলে হিমবাহের চূড়া। বিগত বছরজুড়েই বিশেষজ্ঞরা সাবধান করে যাচ্ছিলেন যে, গুগলের মতো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহের অনুমতি দিচ্ছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো- এই কোম্পানিগুলো ইন্টারনেটে সংবাদ, মতামত বা যেকোনো ঘটনাকেন্দ্রিক প্রচারণার তথ্য একান্ত নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিথ্যা সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার মতো বিষয় বিবেচনায় নিলেই বোঝা যায়, এসব প্ল্যাটফরম কিভাবে মানুষের মতামতকে প্রভাবিত কওে চলেছে। আমরা কেবল ভুয়া অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে মিথ্যা সংবাদ বা তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়ার ভূমিকার বিষয়টি জানা শুরু করেছি। ব্রেক্সিট-বিষয়ক গণভোটে ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকা মানুষকে কতটা প্রভাবিত করেছে, সে বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করেছে।
এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না যে, সরকারই সম্ভবত নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্যে হস্তক্ষেপের অনুমোদন দিচ্ছে এবং এটি একধরনের ‘বড়ভাই’সুলভ আচরণ যা সব জায়গায় সব সময়ই দেখা যায়। আমাদের ডিজিটাল-ব্যবস্থার যে অগ্রযাত্রা ভঙ্গ করা সম্ভব নয় এবং প্রযুক্তিই সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহারের অনুমতি দিতে বাধ্য করছে। কিন্তু বিশ্বজুড়েই গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য চিন্তার বিষয় হলো- সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার এমন লঙ্ঘন গণতন্ত্রের ওপর চরম আঘাত হানতে পারে।
একটি বিষয় লক্ষণীয়, ভার্চুয়াল জগতে ব্যবহারকারীদের প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয় এমন ধারাবাহিক চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকির মধ্যে ফেসবুকের বিষয়টি সর্বশেষ। সরকার এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ব্যবহারকারীরাও রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ও অন্যান্য স্পর্শকাতর তথ্য নিয়ন্ত্রণের ঝুঁকির মধ্যে আছে। এমন আশা করাটাই সঙ্গত হবে যে, এ ক্ষেত্রে হ্যাকার বা শত্রুদেশ থেকে নিজেদের বাঁচাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোই একটা পরিকল্পনা বা নীতি গ্রহণ করবে।
আমাদের জীবনের প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ডিজিটাল মাধ্যমে চলে যাচ্ছে। তাহলে ব্যক্তিগত তথ্য কিভাবে নিরাপদে সংরক্ষিত হবে, তা নিয়ে যে-কেউ ভেবে অবাক হতেই পারে। ফেসবুকের তথ্য নিতে যেখানে অনুমোদন দেয়া হয় কিংবা অন্য তথ্য যেখানে চুরি হয়ে যায়, সেখানে এ বিষয় তো অবশ্যই দুশ্চিন্তারই যে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার করতে পারে।
একইভাবে মজার ব্যাপার হলো, ফেসবুক স্ক্যান্ডালের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া আরব অঞ্চলে নেই বললেই চলে। ঝুঁকি থাকলেও ব্যবহারকারীরা ফেসবুক ছাড়তে চান না বলেই মনে হয়। সহজেই অনুমেয়, বেশির ভাগ আরব দেশেই এমন আসক্তিকে বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় উল্লেখ করা যায় এভাবে- ‘যেখানে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ সবচেয়ে কম, সেখানেই ফেসবুক টুইটারে আসক্তি তত বেশি’।
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এসব প্ল্যাটফর্ম জনগণকে স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ নেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করে। যেহেতু গতানুগতিক গণমাধ্যমগুলো তাদের জন্য সীমাবদ্ধ, তাই মানুষ স্বাভাবিকভাবেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখানে তারা তাদের মতো প্রকাশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন। এর মানে এই নয় যে, মানুষ অনলাইনে তাদের মতামত প্রকাশের জন্য দায়ী হবেন না। বরং আমরা দেখি, বিভিন্ন দেশের সরকার ইন্টারনেটে স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও কার্যক্রম চালানো সীমাবদ্ধ করতে সাইবার অপরাধ আইনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
ফেসবুকের এ ঘটনা থেকে ব্যক্তি, সরকার ও সংস্থাগুলোকে শিক্ষা নিতে হবে, ডিজিটাল দুনিয়া আমাদের জীবনকে বদলে দিয়েছে নানাভাবে। কিন্তু এই বিষয়টি আমাদের কাছে বিলাসিতাই মনে হয়, এমনকি এখানে মানুষের অধিকারকেই জবাবদিহিতা আর চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আরব নিউজ থেকে ভাষান্তর করেছেন মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম
More Link