‘‘ভুল ভাল কিছু করা, নিজের জীবন নষ্ট করার সিদ্ধান্ত আমি নেব না’’

‘‘ভুল ভাল কিছু করা, নিজের জীবন নষ্ট করার সিদ্ধান্ত আমি নেব না’’
আজ তিনি জনপ্রিয় অভিনেত্রী কিন্তু দেবপর্ণা চক্রবর্তীকে পেরিয়ে আসতে হয়েছে অনেক কঠিন সময়। এবেলা ওয়েবসাইটকে জানালেন তাঁর লড়াইয়ের কথা।  

সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনা চিন্তিত করে তুলেছে অভিনয় পেশার সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষকে। যাঁরা অভিনেত্রী বা অভিনেতা হতে চাইছেন বা এই পেশায় নিজের স্বাক্ষর রাখতে চাইছেন, তাঁদের চলার পথটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কঠিন। সেই কঠিন সময়ের সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনেকেই হারিয়ে গিয়েছেন বা যাচ্ছেন। কিছুদিন আগেই পেশাগত অসাফল্যের কারণে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন দুই উঠতি অভিনেত্রী। 

কিন্তু এই পেশায় এখন যাঁরা তারকা, তাঁদেরও একদিন বহু কঠিন রাস্তা পেরতে হয়েছে। দেবপর্ণা চক্রবর্তী বাংলার বিনোদন জগতের নতুন প্রজন্মের প্রতিভাবান অভিনেত্রীদের অন্যতম। কীভাবে তিনি দিনের পর দিন, নিজেই নিজেকে স্ট্রাগল করার প্রেরণা জুগিয়েছেন, এবেলা ওয়েবসাইটকে শোনালেন সেই কাহিনি—  

‘‘আমি ছোটবেলা থেকেই খুব ভিতু ছিলাম, ইনট্রোভার্ট ছিলাম কিন্তু খুব নাচতে ভালবাসতাম। ১০ বছর বয়সে আমি নাচ শেখা শুরু করি। নাচ করতে গেলে অভিনয়টা কোথাও গিয়ে দরকার হয়। আমার যিনি প্রথম নৃত্যগুরু, সৌরভ চন্দ, যাঁকে আমি দাদাভাই বলি, তিনি আমার মা-কে বলেন যে আমার মধ্যে অভিনয়টা আছে, আমাকে অভিনয়টা শেখানো যেতে পারে। আমার মা-বাবা, পরিবারের সবাই এই বিষয়টাকে সাপোর্ট করে। এবং তার পর থেকে আমার অভিনয় জীবনের স্ট্রাগল শুরু হয়। আমার দাদু যাত্রা করতেন। আমার জেঠু নাটক করতেন, আমার বাবা নাটক করতেন। তাই অভিনয়টা হয়তো আমার রক্তে ছিলই।  

আজ আমি যেটুকু অর্জন করতে পেরেছি, সেটা আমার আর আমার পরিবারের জন্য। আমার কোনও গডফাদার ছিল না, কোনও সাপোর্ট ছিল না। আমি জানতামও না স্টুডিও কোথায়, ইন্ডাস্ট্রি কোথায়। আমি একেবারেই পাড়ার স্টুডিও থেকে ছবি তুলি, তারপর টালিগঞ্জের স্টুডিওপাড়ায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় ছবি জমা দিই— যদি ছবি পছন্দ হয়, যদি অডিশনের জন্য ডাকে। প্রচুর অডিশন দিয়েছি। অডিশন দেওয়ার সময় স্ট্রাগলটা ছিল অন্য রকম। আমি থাকি বেলঘরিয়াতে। অত্যন্ত মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি, যেখানে নিজের সন্তানের ভালবাসাগুলোকে প্রশ্রয় দেওয়ার মতো ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও আমার মা-বাবা সেটা করেছে। 

যেহেতু অভিনয়টা ভালবাসতে শুরু করি, সেই জন্যেই। আমি আর মা সকালবেলা বেরিয়ে যেতাম। তখন আমাদের আর্থিক অবস্থা অতটাও ভাল ছিল  না। অডিশন মানেই সারাদিনের ব্যাপার। তাই সকালে ভাত খেয়ে বেরতাম যাতে আর বাইরে খেতে না হয়। কখনও খিদে পেলে রাস্তার ধারের সস্তার দোকান থেকে যাহোক কিছু কিনে খেতাম দু’জনে। কিন্তু সেটা একপ্লেটই হতো। মা কম খেত, আমাকে হয়তো একটু বেশি খাওয়াত। কিন্তু সেই খাবারটা কিনতেও ভাবতে হতো। 

আমি প্রথম কাজ করি ‘আকাশ বাংলা’-র একটি টেলিফিল্মে। সকাল সাতটায় কলটাইম ছিল। আমার প্যাক আপ হয় রাত সাড়ে দশটায়। এবং আমার একটিও শট না দিয়ে প্যাক আপ হয়ে যায়। প্রথম দিনে আমি ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে পারিনি। সেদিন বুঝেছিলাম, এই ইন্ডাস্ট্রিতে টিকে থাকতে হলে সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন সেটা হল ধৈর্য। সেটাই হয়তো আমার সাথ দিয়েছে। তার পরে বিভিন্ন ছোট ছোট কাজ করি। প্রথমেই কোনও বড় চ্যানেলে ভাল সিরিয়ালে ভাল চরিত্র পেয়ে যাওয়া— এরকমটা হয়নি আমার সঙ্গে। অনেক ছোট ছোট কাজ করতে করতে, হয়তো নিজের অভিনয়টা কোনওভাবে দেখাতে পেরেছিলাম বলেই শেষ পর্যন্ত একটা ভাল চরিত্র পাই, জি বাংলা-তে ‘অসম্ভব’-এ। আস্তে আস্তে সেখান থেকে আরও ভাল চরিত্র পাওয়া। 

একটা সময় এরকমও হয় যে আমি এক বছরেরও বেশি বসে ছিলাম। ‘সুবর্ণলতা’ হতো তখন জি বাংলা-তে। সেখানে বকুলের চরিত্রটা করতাম। তার পরে আমি প্রায় এক বছর বসে থাকি। সেই বসে থাকাটা কিন্তু অদ্ভুত ধৈর্যের ব্যাপার ছিল। আমি সেই সময় চরিত্র পাইনি তা নয়। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল যে এতদিন যা কাজ করেছি, সেই জায়গা থেকে দাঁড়িয়ে আমি আরও ভাল কিছু ডিজার্ভ করি। হয়তো আমি ডিপ্রেশনে চলে যেতাম। সেই মুহূর্তটা এসেছিল আমার জীবনে। কিন্তু সেখান থেকেই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিই। একদিন আমার মনে হয়, আমি বাড়িতে বসে আছি কেন? অভিনয়টা আমি স্ক্রিনের সামনে করতে পারছি না হয়তো কিন্তু আমি ছাড়ব কেন?

এর পর আমি প্রথম ফোনটা বাবানদাকে (কৌশিক সেন) করি। বলি যে আমার না মনে হচ্ছে অভিনয়টা আমি ভুলে যাব। কী করা যায়? উনি ওঁদের দলে ডাকেন। এবং আমি একটা চর্চার মধ্যে থাকি। প্রথমেই যে নাটক করতে শুরু করি তা নয়। ওখানে গিয়ে আমি ওদের কাজের পদ্ধতিটা দেখি, স্টেজের পিছনে কাজ করি। করতে করতে আমি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাই, একটা চরিত্র পাই, প্রায় একবছর মতো সেই দলে আমি কাজ করি। তার পরে আবার আমার মনের মতো চরিত্র আসে, পর্দায় আবার কাজ করা শুরু করি। 

কিন্তু সব সময় যে চরিত্র মনের মতো হয় তা নয়। আবার মনের মতো হলেও অনেক রকম বাধা আসতে পারে। এরকমও হয়েছে যে খুব ভাল একটা চরিত্র, ফাইনাল হয়ে গিয়েছে। তিন দিন পর থেকে শ্যুটিং শুরু। তার দু’দিন আগে জানতে পারি যে আমাকে সেই চরিত্র থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। কারণটা জানা নেই। তখনও আমি ভেঙে পড়িনি। আমি নিজেকে মোটিভেট করেছি বার বার এই বলে, যা হয় ভালর জন্য হয় এবং যেটা গিয়েছে সেটা নিয়ে আমি কোনওদিনও রিগ্রেট করব না। যেটা আসবে সেটা আমার ভালর জন্যই হবে এবং আমার ভাল কিছু হবে তাতে। আর সেটাই হয়ে এসেছে। 

এরকম একটা নয় বহু কাজ গিয়েছে এবং বহু কাজ এসেছে। আমি কখনও অভিনয়টাকে সিনেমা বা সিরিয়াল এইভাবে ভাগ করিনি। আমি জানতাম যে আমি খুব সুন্দরী নই, খুব ভাল অভিনেত্রী এমনটাও নয়। আমার খুবই শর্ট হাইট। কিন্তু আমার কাছে যেটা ছিল, সেটা আমার অভিনয়। আমি অভিনয়টা করে গিয়েছি। আমার জানা নেই, ইন্ডাস্ট্রিতে আসতে গেলে বা কাজ করতে গেলে, অন্য কিছু জানার প্রয়োজন আছে কি না। কিন্তু অভিনয়টা জানতেই হয়। 

আমি এখনও স্ট্রাগল করে যাচ্ছি। এটা এমন একটা প্রফেশন যেখানে প্রত্যেক মুহূর্তে স্ট্রাগল করতে হয়। নিজের অস্তিত্বটাকে বোঝাতে হয় নিজের অভিনয়ের মাধ্যমে। আমি কখনও ডিপ্রেসড হয়ে পড়ি না। স্ট্রাগলটাকে পজিটিভ ভাবেই নিয়ে এসেছি চিরকাল। এই মুহূর্তে মনের মতো চরিত্র করছি সিরিয়ালে। ছবিও করেছি। কিন্তু আরও ভাল চরিত্র, ভাল কাজ করার খিদেটা রয়েছে। তার জন্য আরও অনেক স্ট্রাগল করতে হবে। সেখানে নিশ্চয়ই বাধা আসবে। সেই বাধাটাকে পেরতে হবে। কিন্তু তার জন্য আমি ডিপ্রেসড হয়ে পড়ব না। ভুল ভাল কিছু করে ফেলা, নিজের জীবনটাকে নষ্ট করা, এই ডিসিশনগুলো আমি নেব না। এগুলো ভীষণ লেম এক্সকিউজ আমার মনে হয়। তাই সব সময় নিজেকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করছি। পড়াশুনো করছি, নিজেকে অভিনয়ের চর্চার মধ্যে রাখছি, আরও ভাল চরিত্র, আরও ভাল কাজের জন্য।’’