ভারত-পাকিস্তান কী শিগগিরই যুদ্ধ লাগবে ?
দুই প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের নৌ বহরে পারমাণবিক অস্ত্রবাহী সাবমেরিন যুক্ত হওয়ার বিষয়টি এই অঞ্চলে ভয়াবহ যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট ভক্সের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে এসব কথা।
পাকিস্তান প্রকাশ্যেই বলেছে, তাদের নৌ বাহিনীর সাবমেরিনকে পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত করার উদ্দেশ্য ছিলো ভারতের একই ধরনের কাজের পাল্টা ব্যবস্থা। ভক্স ওয়েবসাইটের সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের আগস্টে সাবমেরিনে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করার ঘোষণা দিয়েছিলো ভারত। কাজেই এই প্রতিযোগিতা দুই বৈরি প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধ ডেকে আনতে পারে বলে আশঙ্কা করেছে ভক্স।
এর মধ্য দিয়ে উভয় দেশই যুদ্ধের সবগুলো ক্ষেত্রে পারমাণবিক সামর্থ অর্জন করলো, একে অন্যকে স্থল, আকাশ ও নৌ পথেও পারমাণবিক হামলা চালাতে পারবে এখন। সাধারণত পারমাণবিক যুদ্ধে সাবমেরিনকে বিবেচনা করা হয় সবচেয়ে নিরাপদ বাহন হিসেবে, কারণ এটি শত্রুর হামলা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারে এবং দ্রুত পাল্টা আঘাত হানতে পারে।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে শত্রুতা, যা আজো চলছে। সাম্প্রতিক সময়ে দুটি দেশ জড়িত হয়েছে পারমাণবিক শক্তির দৌড়ে।
দুই প্রতিবেশী দেশের পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার ক্রমশই বাড়ছে। যার প্রভাব এখন পড়তে শুরু করেছে ভারত মহাসাগরেও। তবে ভয়াবহ এই অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের চেইন অব কমান্ড ও অস্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রন হারানোর ঝুঁকি ক্রমশ বাড়ছে এবং এসব অস্ত্র এখন এমন সব জায়গায় স্থাপন করা হচ্ছে যা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।
ইসলামাবাদের কায়েদ ই আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের পারমাণবিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জাফর জাসপাল এ বিষয়ে বলেন, ‘ভারত মহাসাগরের পারমাণবিকিকরণ শুরু হয়েছে। উভয় দেশই সীমা অতিক্রম করছে’।
ভক্সের রিপোর্টে দক্ষিণ এশিয়ার পারমাণবিক পরিস্থিতিকে কোরীয় উপদ্বীপের অবস্থার সাথে তুলনা করা হয়েছে। তবে এতে আরো বলা হয়েছে পারমাণবিক কর্মসূচীর ক্ষেত্রে ইসলামাবাদ ও নয়া দিল্লি উভয় আন্তর্জাতিক তদন্ত এড়াতে পেরেছে। সেই সাথে ওয়েবসাইটটি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, প্রতিযোগিতামূলক সমুদ্রসীমায় অনভিজ্ঞ অফিসারদের নিয়ন্ত্রণে পারমাণাবিক অস্ত্র থাকার কারণে যে কোন সময় হঠাৎ হামলার ঘটনা থেকে দেশ দুটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
দুর্ঘটনা বা অসতর্কতায় আক্রমণ
রিপোর্টে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ব্রিটেন ও ফ্রান্সের পারমাণবিক অস্ত্রসজ্জিত সাবমেরিন রয়েছে এবং এই সাবমেরিনগুলো চলে পারমাণবিক জ্বালানিতে। সেগুলো সবার দৃষ্টি ফাঁকি দিয়ে অনায়াসে মাসের পর মাস পানির নিচে থাকতে পারে। শুধুমাত্র ক্রুদের খাদ্য ফুরিয়ে গেলে সেগুলোকে মাঝেমধ্যে ভাসতে হয়। অন্যদিকে পাকিস্তান, ভারত ও ইসরাইলের যেসব সাবমেরিন রয়েছে তাতে পারমাণবিক অস্ত্র বহন করা হলেও সাবমেরিনগুলো ডিজেল চালিত। বৃহৎ শক্তিগুলোর সাবমেরিনের তুলনায় এগুলোর যন্ত্রপাতিও অনুন্নত, চলার সময় অধিক শব্দ সৃষ্টি করে এবং একটানা দুই সপ্তাহের বেশি পানির নিচে থাকতে পারে না। এই সাবমেরিনগুলো চিহ্নিত করাও সহজ।
ভারত এক লজ্জাজনক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পেয়েছে - হঠাৎ করেই আরিহান্ত সাবমেরিনের হ্যাচ খুলে গিয়ে এর অপারেটিং কক্ষে পানি ঢোকে। ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই ঘটনাকে ‘মানবীয় ভুল’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় চেয়েছিলো ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে। এমনকি ভারতের রাজনৈতিক নেতাদেরও এই ঘটনা সম্পর্কে জানতে দেয়া হয়নি বলে দাবি করেছে ভক্স।
চক্র নামে রাশিয়া থেকে আনা আরেকটি ভারতীয় সাবমেরিনও এক দুর্ঘটনার পর ডক ইয়ার্ডে পড়ে আছে। যেটির মেরামতের জন্য ইতোমধ্যেই ভারতের কাছে ২ কোটি মার্কিন ডলার বিল করেছ রাশিয়া।
পাকিস্তান ঘোষণা দিয়েছে, তারা সাবমেরিন থেকে ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের উৎক্ষেপনের সফল পরীক্ষা চালিয়েছে, যে ক্ষেপণাস্ত্রটি পারমানবিক রকেট ছুড়তে পারে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেশটি তাদের ফ্রান্সে প্রস্তুতকৃত সাবমেরিনে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের পদক্ষেপ শুরু করেছে। তারা আরো ৮টি ডিজেল চালিত সাবমেরিন কেনার জন্য চীনের সাথে চুক্তি করেছে, যেগুলোতে পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করা যাবে। ২০২৮ সালে এগুলো যোগ হবে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে।
নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনা
সমুদ্রে নিয়োজিত অফিসারদের হাতে পারমাণবিক অস্ত্র দেয়ার অর্থ হচ্ছে এতে সামরিক কমান্ডের শৃঙ্খলা ভেঙে যাবে এবং নিয়ন্ত্রণও কমে যাবে বলে দাবি করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমটি। সেই সাথে এই পদ্ধতিতে দুর্ঘটনাবশত হামলার ঘটনার সম্ভাবনা বেড়ে যায়, যা পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলকেই পারমাণবিক যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিতে পারে।
ভারত ও পাকিস্তান- উভয় দেশেরই পারমাণবিক অস্ত্রের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ রাজনীতিকদের হাতে। উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে অনেক সাবধানতা অবলম্বন করে। কিন্তু সমুদ্রে নিয়োজিত পারমাণবিক অস্ত্রের ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। কারণ এখানে ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট ও এর পরিচালনা কার্যক্রম একই সাথে থাকবে, যার দায়িত্বে থাকবে ওই সামমেরিনের গুটি কয়েক ক্রু। সাবমেরিনের ক্যাপ্টেনের হাতেই থাকবে যে কোন কিছু করার স্বাধীনতা। আর এটিই বিপদের আশঙ্কা তৈরি করেছে।
নিউ জার্সির প্রিন্সটোন ইউনিভার্সিটির পারমাণবিক পদার্থবিদ পারভেজ হুদভয় ভক্সকে বলেন, ‘উভয় দেশের জন্যই নতুন বিপদ হচ্ছে যে, সাবমেরিনে থাকা পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ অতটা কড়াকড়ির মধ্যে নেই। বন্দর ত্যাগ করার সময়ই একটি সাবমেরিন পারমাণবিক অস্ত্র ছোড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে। ক্যাপ্টেনকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুমতি বা কোড নাম দেয়া হলেও তিনি নিজে থেকে পারবেন হামলা চালাতে। ’এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন এটিই সবচেয়ে বিপদের কারণ পারমাণবিক সাবমেরিনের ক্ষেত্রে।