তারুণ্যেই পতন হবে পুতিনের?

তারুণ্যেই পতন হবে পুতিনের?
আরও ছয় বছরের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি
গত শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে শেষ দশক পর্যন্ত পুরো বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী—এ দুই ভাগে বিভক্ত ছিল। অথচ সেই প্রবল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ব্লক ভেঙে যেতে সময় লাগেনি। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শব্দচয়নে সেটি ছিল ‘ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ’। ৭০ বছরের বেশি সময় টিকেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ওই অবস্থা থেকে আবার প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে রাশিয়া। নেতৃত্বে ভ্লাদিমির পুতিন। ১৮ বছর ক্ষমতায় থাকার পর আরও ৬ বছরের জন্য দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু পুতিনই-বা কত দিন টিকবেন? সোভিয়েত যুগ না দেখা তারুণ্যের কাছেই কি হেরে যাবেন তিনি—প্রশ্নটি এখন এই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

১৯৮৫ সালে ৭৩ বছর বয়সে মারা যান রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কনস্তানতিন চেরনেনকো। শোক পালনের সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের পরবর্তী নেতা নির্বাচনের তোড়জোড়ও শুরু হয়ে যায়। ক্রেমলিনে কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সভায় জরুরি ডাক পড়ে মিখাইল গর্বাচেভের। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বেসর্বা নেতা ও পার্টির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পড়ে তাঁর কাঁধে। শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া ও সমাজতান্ত্রিক শাসনে পরিবর্তনের যুগ।

চেরনেনকো এমন একটি প্রজন্মের অংশ ছিলেন, যেটি ছিল রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার উত্তাল সময়। ১৯১১ সালে জন্মেছিলেন চেরনেনকো। তাঁর জন্মের ছয় বছরের মাথায় সংঘটিত হয় অক্টোবর বিপ্লব। অভ্যুদয় ঘটে বিশ্বের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। তবে চেরনেনকোর প্রজন্মের ওপর লেনিনের চেয়ে স্তালিনের প্রভাব ছিল বেশি। কারণ, লেনিনের মৃত্যু ও জোসেফ স্তালিনের উত্থানের সময়—এই সন্ধিক্ষণেই রাজনীতি বুঝতে শিখেছিলেন তাঁরা। তাই তাঁদের কাছে নায়ক ছিলেন স্তালিন। বলা হয়ে থাকে, চেরনেনকোর বিদায়ের মধ্য দিয়েই রাশিয়ায় ‘স্তালিনের প্রজন্মের’ ইতি ঘটে। এরপর কমিউনিস্ট পার্টির নীতিনির্ধারকেরা ভেবেছিলেন, নতুন ও তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে নিয়ে আসা দরকার। আর সেই ভাবনা থেকেই পার্টির নেতৃত্বে আসেন গর্বাচেভ।

লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, সমাজতান্ত্রিক শাসন বললেই সব মানুষের বৈষম্যহীন ও সমঅধিকারের একটি চিত্র চোখে ভেসে ওঠে। তবে গত শতাব্দীর আশির দশকে সমাজতান্ত্রিক শাসনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাশিয়ায় সেই সমঅধিকারের বিষয়টি ঠিক স্পষ্ট ছিল না। কারণ, জারের উৎখাতের পরে দেশটিতে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও অভিজাততন্ত্রের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ক্ষমতার বলয়ে থাকা সেই অভিজাতরা সোভিয়েত ইউনিয়নে থাকলেও কখনো বিলাসিতায় কার্পণ্য করেননি। সরকারও তাঁদের বাধা দেয়নি। বরং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাই দিয়েছে বেশি। রুশ সমাজের এই অভিজাতরা কি ভাবছেন, তা নিয়ে বেশ মাথাব্যথা ছিল ক্ষমতাসীনদের। আর আমজনতার জন্য বরাদ্দ ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শের আদলে টানাপোড়েনের সংসার।

মিখাইল গর্বাচেভ ভেবেছিলেন, এই কয়েকজন ব্যক্তির হাতে থাকা তথাকথিত ‘পুঁজিবাদী’ সুযোগ-সুবিধাগুলোকে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দিতে হবে। সেই ভাবনা থেকেই আসে ‘গ্লাসনস্ত’ ও ‘পেরেস্ত্রৈকা’ নীতি। প্রথমটিতে উদারবাদকে প্রাধান্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। আর দ্বিতীয়টিতে ছিল কমিউনিস্ট পার্টি ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের বিষয়টি। এতে করে সোভিয়েত ইউনিয়নে জারি থাকা কঠোর বিধিনিষেধ উঠে যেতে থাকে। সাধারণ মানুষের নাগালে চলে আসে পুঁজিবাদী সমাজের ভোগবিলাস। দুই নীতি কার্যকরের কয়েক বছর পর গর্বাচেভ বলেছিলেন, রাশিয়াকে একটি ‘স্বাভাবিক দেশ’-এ রূপান্তর করতে চেয়েছিলেন তিনি। ‘মানবিক মূল্যবোধগুলো’ সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। গর্বাচেভ বলেছিলেন, ‘পেরেস্ত্রৈকা নীতিতে লাভবান হবে আমার নাতিপুতির প্রজন্ম। তারা আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী ও স্বাধীন হয়ে বেড়ে উঠবে। তারা জানবে যে নিজেদের ওপর বিশ্বাস রাখতে হবে তাদের।’

ফিডর অভচিনিকভের বয়স এখন ৩৬ বছর। গর্বাচেভের নাতিপুতির প্রজন্মের একজন সদস্য তিনি। গর্বাচেভের নেওয়া দুই নীতি কার্যকর হওয়ার পর রাশিয়ায় উদার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাতে উৎসাহিত হয়েই পিৎজার একটি চেইনশপ খোলেন তিনি। দোকানের নাম ডোডো। এখন পুরো রাশিয়ায় এর ৩০০টি শাখা আছে। শুধু রাশিয়া নয়, যুক্তরাজ্য ও আমেরিকাতেও শাখা আছে ডোডোর।

গর্বাচেভের নাতিপুতিরা এভাবেই বেড়ে উঠেছেন। এই প্রজন্মের বেশির ভাগেরই বয়স ৩০ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে। এই বয়সসীমার মধ্যে থাকা এক বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী এখন রাশিয়ার অর্থনীতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। বদলের গানও গাইছেন তাঁরা।

মিখাইল গর্বাচেভের মূলনীতি ছিল ব্যক্তিজীবন ও মানবিক মূল্যবোধের বিষয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া। ছবি: এএফপি

গর্বাচেভের পর ১৯৯১ সালে বরিস ইয়েলৎসিনের হাতে যায় রাশিয়ার শাসনক্ষমতা। এরপর আবার অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ভাবেন রুশ নীতিনির্ধারকেরা। আর সেই চিন্তা থেকেই ভ্লাদিমির পুতিনের উত্থান। ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসেন তিনি। গত ১৮ মার্চ অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়লাভের পর আগামী ছয় বছরের জন্য মসনদে থাকা নিশ্চিত করেছেন পুতিন। কিন্তু আর কত দিন ক্ষমতায় থাকবেন তিনি? ঠিক এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলেই এসে পড়ে গর্বাচেভের নাতিপুতির প্রজন্মের কথা। গর্বাচেভের গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা আবার নতুন করে রাশিয়ায় ফিরে আসবে বলে প্রত্যাশা করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের ধারণা, এই প্রজন্মই রাশিয়ায় সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারবে। তখনই রুশ জনগণের হাতে উঠবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা।

প্রখ্যাত রুশ শিক্ষাবিদ ইউরি লেভাদা বলেন, রাশিয়ায় যখনই নতুন কোনো গোষ্ঠী ক্ষমতায় এসেছে, তারা আগের শাসন কাঠামোর ধারাবাহিকতা নষ্ট করেছে। গর্বাচেভ যেমন আগের ব্যবস্থা খারিজ করে নতুন ব্যবস্থা এনেছেন, তেমনি ইয়েলৎসিনের কাছ থেকে ক্ষমতা লাভের পর পুতিনও আগের সরকারের সবকিছু মুছে ফেলেছেন। ইতিবাচক ব্যবস্থাগুলোও বাতিল করে দেন তিনি। এই বিষয়টিই সব সমস্যার জন্য দায়ী। নতুন শাসক এভাবেই সব সময় নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।

এএফপির খবরে বলা হয়েছে, সরকারি হিসাবে ৭৭ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন পুতিন। অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা ব্যালট বাক্সে কোনো পাত্তাই পাননি। প্রধান বিরোধী নেতা আলেক্সেই নাভালনি দাঁড়াতেই পারেননি নির্বাচনে। কেসেনিয়া সোবচাক অংশ নিলেও পেয়েছেন মোটে ১ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট। অন্যদের অবস্থাও তথৈবচ। সাদা চোখে এঁদেরকেই পুতিনের উত্তরসূরি বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, এঁদের জনপ্রিয়তার মূল কারণই হলো তরুণসমাজের সমর্থন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে চতুর্থ মেয়াদ শেষে পুতিনের বয়স হবে ৭১ বছর। ওই সময় সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা মানতে হলে আবার প্রধানমন্ত্রী হতে হবে পুতিনকে। কারণ, টানা তিনবার প্রেসিডেন্ট হওয়ার নিয়ম নেই রাশিয়ায়। তবে তত দিনে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ২৪ বছর ক্ষমতায় থাকা হয়ে যাবে পুতিনের। সোভিয়েত ইউনিয়ন-পরবর্তী সময়ে যা সর্বোচ্চ।

বরিস ইয়েলৎসিনকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করেছিলেন ইগর মালাশেংকো। সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটি কোনো নির্বাচন নয়। ক্রেমলিনের নির্দেশনায় একটি নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে।’

ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস নামের একটি থিংক ট্যাংকের বিশ্লেষক ইভান ক্রাস্টেভ ও গ্লেব পাভলভস্কি বলেন, পুতিনের পরবর্তী ছয় বছর শাসনকালের মধ্যেই রাষ্ট্রক্ষমতায় অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের আগমন ঘটতে পারে। কারণ, সাংবিধানিকভাবে ২০২৪ সালে আবার ক্ষমতায় আসার লড়াইয়ে নামতে পারবেন না পুতিন।

ভ্লাদিমির পুতিনের মাথায় তরুণ প্রজন্ম নিয়ে চিন্তা নেই, সেটি ভাবলে ভুল হবে। এরই মধ্যে ক্রেমলিনে তরুণ টেকনোক্র্যাটদের ঢোকাচ্ছেন তিনি। ইকোনমিস্ট জানিয়েছে, বর্তমানে রাশিয়ার ৮৫ জন গভর্নরের মধ্যে ৬ জনের বয়স ৪০ বছরের কম। পুতিনের সরকারের ২ মন্ত্রী ও ২০ জন উপমন্ত্রীর বয়স তিরিশ বা তার একটু বেশি। তবে এর মূল উদ্দেশ্য হলো, এসব তরুণকে নিজের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু পাশার দান উল্টে যেতে কতক্ষণ?
রাশিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা বাহিনীর দাপট সবচেয়ে বেশি। ছবি: রয়টার্স

দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, সোভিয়েত অর্থনীতির পতনের সঙ্গে সঙ্গেই সমাজতন্ত্রের মানবিক মুখশ্রী ম্লান হয়ে গেছে। আগে যেমন সোভিয়েত রাশিয়ার সর্বোচ্চ নেতাকে সমাজতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে বিশ্বব্যাপী উপস্থাপন করা হতো, সেটি বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার লাখ লাখ মানুষ আদর্শিকভাবে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। সামাজিক মর্যাদা ও সঞ্চয় নিয়ে আতঙ্কে ভোগা শুরু করে তারা। আর সেই মানসিক অবস্থাকে পুঁজি করেই নিজের ক্ষমতা সুসংহত করেন পুতিন। রুশ জাতীয়তাবাদকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। আবার রুশ জনগণকে পরাশক্তির অংশ হওয়ার স্বপ্ন দেখানো শুরু হয়। এভাবেই স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার, সম্পদের পুনর্বণ্টন প্রভৃতি ধামাচাপা দিয়ে উত্থান হয় পুতিনের। আবার আসে পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব। অথচ এর ঠিক উল্টো ভাবাদর্শ নিয়ে গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রৈকা নীতি নিয়ে এসেছিলেন গর্বাচেভ।

রুশ অভিজাততন্ত্রের কিন্তু কোনো পরিবর্তন হয়নি। পুতিনের আমলেও তাঁরা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন। সামাজিক শ্রেণিবিভাগ বজায় রাখতে সাহায্য করেছে পুতিনের ‘শর্তসাপেক্ষে সম্পদের অধিকারের’ নীতি। আর এর ফলে পুতিনের বন্ধুবান্ধব ও মিত্রদের নিয়ে গড়ে উঠেছে অভিজাততন্ত্রের নতুন নতুন শাখা। এসব ব্যক্তি নিজেরা যেমন সম্পদ ও ক্ষমতার বলয়ে থাকছেন, তেমনি জায়গা করে দিচ্ছেন সন্তানদেরও। পুতিন সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা হওয়ায় অভিজাত ক্লাবের নতুন সদস্যদের মধ্যে ওই সব সংস্থার সাবেক কর্মকর্তাদের আধিক্যও আছে বেশ।

তবে হ্যাঁ, প্রজন্মের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে এই অভিজাতদের। তাঁরা নিজেদের জন্য এখন সম্পদের শর্তহীন অধিকার আদায় করে নিতে চাইছেন। পারিবারিক উপাধিকে চিরস্থায়ী বৈভবের পরিপূরক করে তোলাই তাঁদের মূল লক্ষ্য।

অবশ্য অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা এত সুবিধা পেয়েও চাইছেন না পুতিনকে। রাশিয়ার বিরোধীদলীয় নেতা দিমিত্রি গুডকভের বাবা ছিলেন সাবেক কেজিবি কর্মকর্তা। ৩৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিক বলেন, ‘অভিজাত বংশের সন্তানেরা তাঁদের মা-বাবার ছায়ায় থাকতে অস্বস্তিবোধ করেন। বিশ্বের সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে থাকতে চান না তাঁরা। অহেতুক পশ্চিমাবিরোধী মনোভাবও তাঁদের অপছন্দ। এখনই প্রকাশ্যে পুতিনবিরোধী কথা বলে নিজেদের ব্যবসা নষ্ট করার ঝুঁকি তাঁরা নিতে চান না। কিন্তু তাঁরা অনবরত ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে যে পুতিনবিরোধী আন্দোলনে আমাদের পাশেই আছে তাঁরা।’

দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির হয়ে কাজ করায়, পুতিনের মধ্যে আছে সহজাত পশ্চিমাবিরোধী মনোভাব। সেটিই তিনি রাষ্ট্রের নীতিতে প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। পুতিনের জীবনীকার নাটালিয়া গেভরক্যান বলেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রজন্মের অংশ ছিলেন পুতিন। সেই হিসেবে পশ্চিমা সুযোগ-সুবিধা ও পণ্য ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষার তালিকায়। কিন্তু কেজিবি কর্মকর্তা হিসেবে পশ্চিমা দেশগুলোকে শত্রু হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত তিনি। আর সেই পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রই প্রধান।

ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও নির্বাচনে অংশ নিতে চান তরুণ রুশ নাগরিকেরা। ছবি: এএফপি

অন্যদিকে, গর্বাচেভের আমলে যাঁদের জন্ম, তাঁরা এখন যুবক। তিরিশের কোঠায় তাঁদের বয়স। এই প্রজন্ম জন্মের পর থেকেই পশ্চিমা জীবনযাত্রার সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে। অর্থসংকটে তারা ভুগেছেন কম। বিলাসী কেনাকাটা, ব্যয়বহুল রেস্তোরাঁয় খাওয়া তাদের জন্য ‘স্বপ্ন’ ছিল না। এখন পশ্চিমা কায়দায় তৈরি সংস্থা, নিয়মনীতি ও অধিকার তারা পেতে চান রাশিয়ায়। এই প্রজন্ম বিনিয়োগের স্বাধীনতা চায়। কোনো বিধিনিষেধ চায় না। পরাশক্তি হওয়ার স্বপ্ন বা নতুন নতুন ক্ষেপণাস্ত্রের খবর তাদের আন্দোলিত করে না। তারা বরং ভালোভাবে বেঁচে থাকতে চায়। তাই রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত প্রোপাগান্ডা তাদের কানে ঢোকে না।

মূলত, রাশিয়ার তরুণ উদ্যোক্তাদের এক বিশাল দল পুতিনের পরিবর্তন চাইছে। তারা এমন একটি ব্যবস্থা চায়, যেটি নিরপেক্ষ নিয়মে চলবে এবং প্রতিযোগিতার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। কারণ, পুতিনের রাশিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতির কারণে স্বাধীন ব্যবসা করাই কঠিন হয়ে পড়েছে। রাশিয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্যদের দাপট সবচেয়ে বেশি। কারণ, তাদের দিয়েই তো একচেটিয়া ক্ষমতা ধরে রেখেছেন পুতিন। আর সর্বময় ক্ষমতার অপব্যবহার হওয়াই তো স্বাভাবিক।

এখন রুশ তরুণ নাগরিকদের ৭৫ শতাংশই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাকরি পেতে চায়। সম্প্রতি এক জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে। কারণ, সেখানেই লাভ বেশি। ক্ষমতা যেমন আছে, উপরিও আছে। আবার অন্যায় করলে আছে দায়মুক্তিও।

গর্বাচেভের মূলনীতি ছিল ব্যক্তিজীবন ও মানবিক মূল্যবোধের বিষয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া। এমনকি রাষ্ট্র পরিচালনার চেয়ে এই বিষয়গুলোয় বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু পুতিন এসে সব পাল্টে দিয়েছেন। এখনকার তরুণ প্রজন্ম গর্বাচেভের মূলনীতিকে আবার ফিরিয়ে আনতে চায়।

থিংক ট্যাংক মস্কো কারনেগি সেন্টারের বিশ্লেষক আলেক্সান্ডার গবেভ বলেন, রাশিয়ায় এখন যে রাষ্ট্রব্যবস্থা চলছে, তা শুধু অকার্যকর নয়, অনৈতিকও বটে। রাষ্ট্রের সেবাদাতা হওয়া উচিত, মূর্তি নয়।

ব্যর্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও নির্বাচনে অংশ নিতে চান তরুণ রুশ নাগরিকেরা। এর পেছনে আছে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। ৩৬ বছর বয়সী তরুণ রাজনীতিক ওলগা মসটিনসকায়ার কথায়, ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণ আপনাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করবে। যদি এখন নাও হয়, একদিন নিশ্চয়ই সব পরিবর্তন হবে।’