আফগানিস্তানে ত্রিমুখী সঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্র

এশিয়া
আফগানিস্তানে ত্রিমুখী সঙ্কটে যুক্তরাষ্ট্র
আফগানিস্তানে সর্বশেষ হামলাগুলো থেকে একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে গেছে, আগের মার্কিন প্রেসিডেন্টদের মতো ট্রাম্পও দেশটিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। গত সোমবার কাবুল ও কান্দাহারে সর্বশেষ হামলার ঘটনাগুলো ঘটে। এতে ৫০ জনেরও বেশি নিহত হয়। 
সমালোচকেরা বলছেন, আফগানিস্তানে ১৬ বছরের যুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র এখন ত্রিমুখী সঙ্কটে জড়িয়ে পড়েছে। তা হলো-তারা এ যু্েদ্ধ জিততে পারবে না, আবার যুদ্ধ থামাতেও পারবে না এবং দেশটি থেকে চলে যেতেও পারবে না।

অসামরিক লোকজনের হতাহতের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। সম্প্রতি আমেরিকান ও ন্যাটো সেনাসংখ্যা বৃদ্ধির কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে অত্যন্ত নাজুক নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করেছে। এ সমস্যার একটি কারণ ‘আইএস ও তালেবান সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালানোর ক্ষেত্রে’ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত রয়েছে। কাবুলে সোমবারের জোড়া আত্মঘাতী হামলার দায় আইএস স্বীকার করেছে। ভোটার নিবন্ধনকেন্দ্রে গত সপ্তাহের হামলায় ৬০ জন নিহত হওয়ার পর কাবুলের এ জোড়া হামলা চালানো হয়।

তালেবান জানুয়ারিতে দুইটি বড় হামলা চালায়। এর একটিতে বিস্ফোরকবোঝাই অ্যাম্বুলেন্স বিস্ফোরণে প্রায় ১০০ জন নিহত হয়। দ্বিতীয় হামলায় কাবুলের একটি বিলাসবহুল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। গত সপ্তাহে তালেবান বসন্তকালীন অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়ে এর চেয়ে আরও ভয়াবহ হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে। মার্কিন হিসাব অনুযায়ী আফগানিস্তানের ৬০ ভাগেরও কম নিয়ন্ত্রণ করে সরকার, আর বাকি অংশ বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে।

অন্য সমস্যাটি হচ্ছে, বিদ্রোহীরা এখন বিশেষত আফগানিস্তানের দুর্বল ও ভঙ্গুর গণতন্ত্রকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে বেছে নিয়েছে। তা ছাড়া তারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অফিস, স্থানীয় ও পশ্চিমা পত্রিকায় কর্মরত সাংবাদিক ও গত বছরের সংসদ নির্বাচনে দায়িত্বরত কর্মকর্তাদের ওপরও পুনঃপুন হামলা চালিয়ে আসছে।

গত বছরের আগস্ট মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার আগের ‘আঘাত না করার নীতি’ থেকে সরে এসে ‘বিজয়ের জন্য যুদ্ধ’ নামে একটি কৌশল ঘোষণা করেন। এরপর ট্রাম্প আফগানিস্তানে আরও তিন হাজার অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করেন, বিদ্রোহী দমন ইউনিটের কার্যক্রম ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন এবং চলমান সঙ্কট উত্তরণে সাহায্য চেয়ে ন্যাটো দেশগুলোকে আরও সক্রিয় হতে বলেছেন। আসলে ট্রাম্পের উদ্যোগ প্রায় পুরোপুরি অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে সেই সময়ই, যখন আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে সন্দেহভাজন আইএস ঘাঁটিতে গত বছর ‘মাদার অব অল বোম্বস (এমওএবি)’ নামক বোমা দিয়ে হামলার নির্দেশ দেন। এ হামলার পর ট্রাম্প আফগানিস্তানে তার ‘বিশাল বিজয়’ হয়েছে বলে দাবি করে গর্বসহকারে বক্তব্য দেন।

পরে সশস্ত্র ড্রোনের মাধ্যমে হামলা, মার্কিন বিমানবাহিনী ও বিদ্রোহী দমন ইউনিটের সদস্যদের ব্যাপক ব্যবহারের ফলে সঙ্কট প্রশমিত ও শান্তিপ্রক্রিয়া জোরদার না হয়ে বরং এর উল্টো ফল দেখা দেয়। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসঙ্ঘ থেকে প্রকাশিত এক পরিসংখ্যানে বলা হয়, গত বছর থেকে বৃদ্ধি পাওয়া বিদ্রোহীদের নির্বিচার হামলায় প্রায় তিন হাজার ৫০০ নিহতসহ ১০ হাজারের অধিক সাধারণ মানুষ হতাহত হয়েছে। অতীতের মতো বিদ্রোহীদের হামলায় বেশির ভাগ হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলা হলেও তা সম্পূর্ণরূপে ঠিক নয়। এ হতাহতের পেছনে মার্কিন বাহিনী ও দেশটির সরকারি বাহিনীরও দায় রয়েছে।

বাস্তবসম্মত ও সামগ্রিক মার্কিন কৌশল না থাকার কারণে আফগান সঙ্কট জটিল ও দীর্ঘায়িত হচ্ছে এবং আফগানিস্তানের মাটি আমেরিকান সেনাবাহিনীর অস্ত্র পরীক্ষার স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিছিন্ন মতের জন্য পরিচিত রিপাবলিকান সিনেটর র‌্যান্ড পল বলেন, ট্রাম্পের উচিত আফগানিস্তান ত্যাগ করার নীতি ভুলে না গিয়ে ‘বিজয়ের জন্য যুদ্ধ’ নীতি ভুলে যাওয়া। অবশ্য আফগান সঙ্কট নিয়ে ট্রাম্প যাই বলুন না কেন, আমেরিকা যে দেশটিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য আটকে পড়েছে সে বিষয়টি অনেকে সন্দেহাতীতভাবেই বিশ্বাস করেন। ফলে গতানুগতিক চিন্তাচেতনা দিয়ে এ যুদ্ধে যে বিজয়লাভ করা সম্ভব নয় তা ওয়াশিংটন মোটামুটি মেনে নিয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র না পারবে আফগান যুদ্ধ স্থগিত করতে, না পারবে বিদ্রোহীদের সাথে শান্তি আলোচনা প্রত্যাখ্যান করতে। কূটনৈতিক পন্থাকে অবজ্ঞা করে চলা ট্রাম্পের নীতির কারণে আফগান সঙ্কট ক্রমেই সিরিয়ার মতো জটিল আকার ধারণ করছে। 
সূত্র : গার্ডিয়ান