ফুটবল
রাশিয়া বিশ্বকাপ : এতো টাকা পুরস্কার পাবে চ্যাম্পিয়ন দল!
বিশ্বকাপের ২১তম আসরের পর্দা উঠছে আগামী ১৪ জুন। ৩২টি দল এতে অংশ নিবে। ১১টি শহরের ১২টি স্টেডিয়ামে সর্বমোট ৬৪টি খেলার অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ১৫ জুলাই মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে এই আসরের ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে। ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আসরে অংশ নেয়া দলগুলো পাবেন অনেক অর্থমূল্য। চ্যাম্পিয়ন দল পাবে তিন কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় দাড়ায় তিন শ' ২২ কোটি ৭৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা।

চ্যাম্পিয়নদের সাথে লড়াই করা রানার-আপ দলটি পাবে দুই কোটি ৮০ লাখ।

এরপর তৃতীয় স্থানে থাকা দল পাবে দুই কোটি ৪০ লাখ। আর চতুর্থ স্থানে থাকা দলটি পাবে দুই কোটি ২০ লাখ।

দেখে নিন পুরস্কারের অর্থমূল্যের পুরো তালিকা-

অবস্থান-----------প্রতি দল----------------মোট (মার্কিন ডলার)

চ্যাম্পিয়ন--------৩ কোটি ৮০ লাখ------৩ কোটি ৮০ লাখ
রানার-আপ------২ কোটি ৮০ লাখ------২ কোটি ৮০ লাখ
তৃতীয় স্থান-------২ কোটি ৪০ লাখ------২ কোটি ৪০ লাখ
চতুর্থ স্থান---------২ কোটি ২০ লাখ------২ কোটি ২০ লাখ
৫ম-৮ম স্থান------১ কোটি ৬০ লাখ------৬ কোটি ৪০ লাখ
৯ম-১৬তম স্থান---১ কোটি ২০ লাখ------৯ কোটি ৬০ লাখ
১৭তম-৩২তম স্থান---------৮০ লাখ-----১২ কোটি ৮০ লাখ

সর্বমোট------------------------------------৪০ কোটি

উল্লেখ্য, রাশিয়া বিশ্বকাপ পুরস্কারের অর্থমূল্য ঘোষিত হয় ২০১৭ সালের অক্টোবরে।



বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা ম্যাচ

মেক্সিকোতে বসেছিল নবম ফুটবল বিশ্বকাপের আসর। সেই বার একটি সেমিফাইনাল ম্যাচকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বকাপের ইতিহাসের সেরা খেলা।

১৭ জুন ১৯৭০। স্থান মেক্সিকোর আজটেক স্টেডিয়াম। বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পশ্চিম জার্মানি আর ইটালি। শুরু হলো খেলা।

সে তো খেলা নয়, সে এক দুরন্ত লড়াই। কেউই হারতে রাজি নয়। হারতে চাওয়ার কথাও নয়। যে হারবে সেই বাদ পড়বে। জয়ী দল শিরোপা জয়ের আরো কাছাকাছি চলে যেতে পারবে। তাই কেউ কাউকে এক চুলও জমি ছাড়ছে না। দারুণভাবে জমে উঠেছে খেলা। আক্রমণে, প্রতি-আক্রমণে আজটেক স্টেডিয়াম ভরা দর্শক তখন উত্তেজনায় টানটান। মেক্সিকোর মানুষ জার্মানির সমর্থক। ইটালির কাছে হার মানতে হয়েছে তাদের। তাই ইটালিকে অপছন্দ করে তারা। পুরো স্টেডিয়াম তাই চিৎকার করে, হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়দের। নির্ধারিত সময়ে উভয় দলই একটি করে গোল করলো। ফলে খেলা গড়ালো অতিরিক্ত সময়ে।

খেলা শুরু হওয়ার আট মিনিটের মাথায় ইটালি এগিয়ে গেলো। প্রায় পঁচিশ গজ দূর থেকে বোনিনসেগনারের শটটি উড়ে এসে জার্মান গোলরক্ষক সেফ মেয়ারের নাগালের বাইরে দিয়ে গোলে ঢুকে গেলো। এগিয়ে গেলো ইটালি। ইটালি চেয়েছিল ওই এক গোলের মূলধন নিয়েই ফাইনালে পৌঁছে যেতে। তাই গোল বাড়াবার দিকে নজর আর না দিয়ে তারা জান-প্রাণ লড়িয়ে দিলো গোল বাঁচাতে। তা কেল্লা প্রায় ফতে করে ফেলেছিলো তারা। কিন্তু বাধ সাধলেন জার্মান দলের ফুল ব্যাক কার্ল হেইঞ্জ চ্যালিঞ্জার।

ছয় ফুট লম্বা, পাতলা চেহারা, এক মাথা সোনালি চুলের এই খেলোয়াড়টির দক্ষতা অসাধারণ। রক্ষণভাগে তিনি যেমন চীনের প্রাচীর গড়তে পারেন, আক্রমণে উঠে এসে তিনিই তেমনি প্রতিপক্ষ দলকে দিতে পারেন প্রচণ্ড ধাক্কা। তাই তিনি দিলেন ইটালিকে। খেলার সময় গড়িয়ে যাচ্ছে দেখে চ্যালিঞ্জার সবার অলক্ষ্যে এক ফাঁকে বল নিয়ে উঠে এসে আচমকা গোল করে বসলেন। এবং সমতায় ফিরে এলো পশ্চিম জার্মানি।

কিন্তু ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই চমকে উঠলেন সবাই। একী! কাঁটা যে ৯০ মিনিটের সময় সীমা পেরিয়ে গেছে। আসলে আহত খেলোয়াড়দের শুশ্রুষার জন্যে বেশ কিছু সময় নষ্ট হয়েছিল। মেক্সিকোর রেফারি আর্থার ইয়ামাসকি নষ্ট হওয়া সময়ের খানিকটা পুষিয়ে দিচ্ছিলেন। তাই তো সম্ভব হলো পশ্চিম জার্মানির পক্ষে সমতায় ফিরে আসা।

শুরু হলো আধ ঘণ্টার অতিরিক্ত সময়ের খেলা। আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন দুই দলের খেলোয়াড়রা। ইটালির লুইগি রিভা, আজোলার বদলি রিভেরা একদিকে আক্রমণ শানাচ্ছেন। অন্যদিকে ইউ সিলার, জার্ড মুলার বারবার ত্রাস সৃষ্টি করতে লাগলেন ইটালির রক্ষণভাগে। কানা-ঘুষায় শোনা যেতো সিলার-মুলারের মধ্যে নাকি চরম রেষারেষি। কিন্তু খেলার সময় তার আঁচটুকুও পাওয়া গেল না। সুন্দর বোঝাপড়ার মাধ্যমে দু’জন মিলে জার্মানির আক্রমণ এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন।

খেলা তখন মিনিট পাঁচেক গড়িয়েছে। হঠাৎ ইটালির গোলের কাছে ভিড়ের ফাঁকে বল পেয়ে চট করে মুলার সেটি ঠেলে দিলেন গোলে। এগিয়ে গেলো পশ্চিম জার্মানি ২-১। তারপর মিনিট চারেক গড়িয়েছে কি গড়ায়নি, ইটালির ফুলব্যাক টারসিসিও বার্গনিচ বল নিয়ে উঠে আচমকা গোল করে দিয়ে গেলেন অনেকটা স্লেলিঞ্জারের মতো। ইটালি সমতায় ফিরে এলো ২-২। চার মিনিট পরে আবার গোল করে এগিয়ে গেলো ইটালি। মাঝ মাঠ থেকে এঞ্জেলো ডোমেনঘিনি বল বাড়িয়ে দিতেই ছুটে এসে বলটা পয়ে তুলে নিলেন লুইগি রিভা। চকিতে শরীরের মোচড়ে ধরাশায়ী করে দিলেন জার্মান দলের দু’জন খেলোয়াড়কে। তার সামনে তখন সেফ মেয়ার। মেয়ার রিভার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার তালে ছিলেন। কিন্তু তাকে সে সুযোগ দিলেন না রিভা। বাঁ দিকের পোস্ট ঘেঁষে বলটা ঠেলে দিলেন জার্মানির জালে।

ইটালি তখন ৩-২ গোলে এগিয়ে। ওদিকে ইটালির গোলের কাছে ছোঁক ছোঁক করছিলেন জার্ড মুলার। চতুর মুলার জানতেন সুযোগ আসবেই। এলোও এবং কেউ কিছু বোঝার আগে শূন্যে লাফিয়ে উঠে বলের ওপর শুধু গোলরক্ষক আলবার্টোসিকে জালের মধ্যে থেকে বলটা কুড়িয়ে আনতে দেখে। ফলাফল আবার এক বিন্দুতে ৩-৩। গোলের পর সবে সেন্টার হয়েছে। হঠাৎ দেখা গেলো বেনিনসেগনা বাঁ প্রান্ত ধরে চোঁ-চোঁ করে দৌঁড়াচ্ছেন। তার পায়ে বল। কয়েকজন জার্মান খেলোয়াড় তেড়ে গেলেন তার দিকে। যা চেয়েছিলেন তিনি তাই হলো। ততক্ষণে রিভেরা ছুটে এসে জায়গা নিয়ে নিয়েছেন। বেনিনসেগনাকে রোখার দিকে নজর থাকায় রিভেরাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামাননি। ঠিক সেইটাই ছিল পরিকল্পনা।

এইবার বেনিনসেগনা বলটা ঠেলে দিলেন গোলের মুখে, ফাঁকায় দাঁড়ানো রিভেরাকে। তার সামনে তখন একা এবং অসহায় সেফ মেয়ার। রিভেরা ডান দিকে মারার ঝোঁক দিতেই মেয়ার ঝাঁপিয়ে পড়লেন সেইদিকে। রিভেরা বাঁ ডিক দিয়ে বলটা ঠেলে দিলেন গোলে। আবার এগিয়ে গেলো ইটালি ৪-৩।

খেলার সময় গড়িয়ে গেছে। জার্মান খেলোয়াড়রা আপ্রাণ চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু পেরে উঠলেন না। পারবেনই বা কি করে? ইটালির খেলোয়াড়রা নেমে এসে গোলের কাছে পাঁচিল তুলে দাঁড়িয়ে গেলেন। পশ্চিম জার্মানির সব আক্রমণ এসে আছড়ে পড়তে লাগলো সেই পাঁচিলের ওপর। তাকে ডিঙিয়ে যেতে পারলো না একবারও। নতুন করে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো ক্ষমতা সেই মুহূর্তে কারো ছিল না। ক্লান্তিতে, দুই দলের খেলোয়াড়দের অবস্থা তখন মৃত্যুপথযাত্রীর মতো।

পরিশ্রমে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কারো মুখ, কারো মুখ যন্ত্রণায় নীল। ফর্সা মুখগুলো রাঙা হয়ে উঠেছে। হাপরের মতো বুক ওঠানামা করছে। পা টলছে। সব থেকে করুণ অবস্থা পশ্চিম জার্মানির ফ্রাঞ্জ বেকেন-বাউয়ারের। খেলার সময় চোট পেয়ে কণ্ঠাস্থি সরে গিয়েছিল। অসহ্য যন্ত্রণা। তবু পরোয়া নেই। তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ বেঁধে আবার নেমে পড়লেন লড়াইয়ে। শেষ অবধি ঘণ্টাখানেক ওই অবস্থাতেই খেলে গেলেন।

ইউ সিলারের মাথা ভর্তি টাক ঘামে চকচক করছে। সিলারের অফুরন্ত দম। সারাক্ষণ মাঠ চষে বেড়ালেও তার দমে টান পড়ে না, কিন্তু তিনিও বেসামাল। ডোমেনগিনির সুনাম খেটে খেলার জন্যে। পরিশ্রমে, আঘাতে তিনিও অস্থির হয়ে পড়েছেন।

খেলার শেষ বাঁশি বাজতেই পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়রা শুয়ে পড়লেন মাঠে। এতো খেটেও জিততে পারলেন না। মন-প্রাণ কেঁদে উঠলো। তবু উঠলেন। টলতে টলতে এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানালেন ইতালির খেলোয়াড়দের। জড়িয়ে ধরলেন তাদের। ইটালি জিতলেও খেলোয়াড়ি আচরণের দিক দিয়ে ইটালিকে টেক্কা দিলো পশ্চিম জার্মানি। জার্মান খেলোয়াড়দের বন্দনায় মুখর হয়ে উঠলো আজটেক স্টেডিয়াম। দুই ঘণ্টার দুরন্ত লড়াইয়ে তারা যা দেখেছেন তা মনের মণিকোঠায় চিরকাল জলজল করবে। তারা যে দুই ঘণ্টা ধরে দেখলেন শতাব্দীর সেরা খেলাটি।

সেদিন যারা খেলেছিলেন :

ইটালি : আলবার্তোসি, বার্গনিচ, রোসাটো, সেরাও, ফেচেটিং, বার্লিন ও মাজোলা (বিভেরা), ডিসিস্তি, ডোমেনগিনি, বেনিনসেগনা ও লুইগি রিভা।

পশ্চিম জার্মানি : সেপ মেয়ার, পাজাক, স্কালজ, চ্যালিঞ্জার ও গেটস, বেকেনবাউয়ার ও ওভারথ, গ্রাবাউস্কি, ইউ সিলার, জার্ড মুলার ও লোহার।

রেফারি : আর্থার ইয়ামাসকি (মেক্সিকো)