ফুটবল
বিশ্বকাপের সেই গোলটি নিয়ে কী বলেছিলেন ম্যারাডোনা
ম্যারাডোনার সেই গোল
কখনও কি ভাবতে পেরেছিলাম?
আমি বুয়েনস এয়ার্সের ঘিঞ্জি বস্তির দরিদ্র সন্তান, কোথাকার কে এক দিয়েগো ম্যারাডোনা, বিশ্বকাপ খেলে ফেললাম। এক আধটা নয়, চারটে! শুধু তাই নয়, আরো কত কী ঘটে গেল আমার জীবনে, স্বপ্নের মতো।
যে চারটে বিশ্বকাপ খেলেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৮৬। মেক্সিকো। কারণটা আপনারা জানেন। ২৯ জুন, ১৯৮৬ তারিখটা কী করে ভোলা সম্ভব? আজটেক স্টেডিয়ামে সে দিন আমার হাতেই ধরা ছিল বিশ্বকাপ। উঁচুতে তোলা, যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে সে। আমিও। সত্যি? নাকি স্বপ্ন? সংশয়, তর্কের কোনো অবকাশ নেই, ওটা আমার ফুটবল জীবনের চিরশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। একটা
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আর্জেন্টিনার ভক্তদের। নিজেকেও। বিশ্বকাপটা ফিরিয়ে আনব আর্জেন্টিনায়। প্রতিশ্রুতিটা পালন করতে পেরে নিজেই সম্মানিত বোধ করছিলাম।
১৯৭৮-এ আমরা প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। স্কোয়াডে নির্বাচিত হয়েও খেলা হয়নি। কোচ ‘ফ্ল্যাকো’ মেনোত্তি শেষ মুহূর্তে আমাকে বাদ দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ছেলেটা বড্ড বাচ্চা। অন্তত বিশ্বকাপের পক্ষে। আমি কি করেছিলাম জানেন? গলা ভেঙে ফেলেছিলাম। প্রথমে কেঁদে। পরে আমাদের দলটার সমর্থনে চিৎকার করে। বিশ্বাস করুন, বাদ পড়ার পর একটা সময় শুধু কেঁদেছি। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।
সেই কান্নার শেষ ১৯৮২-তে, স্পেনে। অবশেষে বিশ্বকাপ খেলল আপনাদের এই দিয়েগো। কিন্তু ওটা একটা দুঃস্বপ্ন, আজও। যাদের কাছে হেরে গেলাম, সেই ইটালিই সেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। ওই ম্যাচটাও কখনও ভুলব না। আমাকে ভয়ঙ্কর কড়া পাহারায় রেখেছিল ক্লডিও জেন্তিলে। কিন্তু এর নাম পাহারা? আমাকে থামাতে সেদিন কি করেনি? বিচ্ছিরি সব ফাউল। মারের পর মার। এমনকি জার্সিও
ছিঁড়ে দিয়েছিল। তারপর ব্রাজিল ম্যাচে লাল কার্ড দেখলাম। অপেক্ষায় ছিলাম চারটে বছর, তাকিয়ে ছিলাম ১৯৮৬-র দিকে, বদলা নেয়ার জন্য। আমার মাথায় তখন প্রতিশোধের আগুন।
১৯৮৬-র বিশ্বকাপ সবদিক থেকেই স্মরণীয়। কোচ কার্লোস বিলার্দো, যিনি ‘বিগ নোজ’ নামে পরিচিত, আমাকে নেতৃত্ব দিতে বললেন। কবে প্রস্তাবটা এলো? ১৯৮৩-তে, বিশ্বকাপের তিন বছর আগেই! আমি, কী বলব, রোমাঞ্চিত। আলোড়িত। অভিভূত। হাতে অফুরন্ত সময়, রণকৌশল, পরিকল্পনা ছকে নেয়ার জন্য। ইটালির লিগে নাপোলিতে তখন চুটিয়ে খেলছি, বিশ্বকাপের ঠিক আগে ওদের হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমটা শেষ করলাম। নেপোলি সেবার তিন নম্বরে থাকল, আমি এগারো গোল করলাম। ক্লাব দলের উন্নতিতে খুশি ছিলাম, কিন্তু আমার চোখে যে তখন বিশ্বজয়ের রঙিন স্বপ্ন বারবার হানা দিচ্ছে। সতীর্থদের সাথে মানিয়ে নিতে, নিজেকে আরো তৈরি ও ধারালো করতে ফিরে এলাম দেশে।
সেবারের দলটায় আমার কত বন্ধু ছিল! বাতিস্তা, বুরুচাগা, গিউস্তি, ওলার্তেকোচিয়া, ভালদানো, রুগেরি, ব্রাউন, কুসিওফো, এনরিক। আমার তখন একটা সংঘবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ দল। ঝগড়া নেই, সঙ্ঘাত নেই, ব্যক্তিগত লড়াই নেই, একেবারে সুখি পরিবার। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের মধ্যে প্রতিশোধের নেশা ছিল, ঔদ্ধত্য ছিল না। আত্মবিশ্বাস ছিল, অহঙ্কার ছিল না। এটা, আমি
বিশ্বাস করি, একটা দলকে সাফল্যের ঝলমলে চূড়াটায় তোলার জন্য খুব জরুরি।
মেক্সিকোয় পৌঁছে আমাদের ঘাঁটি ছিল পুয়েবলোয়। গ্রুপে কোরিয়াকে হারালাম। ইটালির সাথে বদলাটা সেভাবে নেয়া গেল না, ১-১। বুলগেরিয়াকে মারলাম, ২-০। তবে ইটালি ম্যাচ একটা অন্য তৃপ্তি দিয়ে গেল। ওদের গোলরক্ষক গেলির বিরুদ্ধে করলাম আমার জীবনের অন্যতম প্রিয় গোল। আর্জেন্টিনা ভাল খেলছিল। টেকনিক অবশ্যই দরকার, ওটা তো ছিলই, আর ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি। কাপ জয়ের জন্য জান বাজি রাখার অঙ্গীকার। উরুগুয়েকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছলাম, সামনে ইংল্যান্ড।
ইংল্যান্ড! সেই ইংল্যান্ড! আর কি শুধুই ফুটবল ম্যাচ থাকে ওটা! ওই খেলা হয়ে উঠল যুদ্ধ। বহু আগে আমাদের কিছু স্বৈরতন্ত্রী একটা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন-ফকল্যান্ড! ইতিহাস তো মিথ্যা হতে পারে না, আমাদের চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কত অসংখ্য আর্জেন্টিনীয়কে যে হত্যা করেছিল ওই বর্বর ইংরেজরা! ওদের তাই কোনও দিন ক্ষমা করতে পারিনি, সারা জীবনে পারব না। আমাদের দেশবাসীরও কাতর আবেদন ছিল, এবার বদলা চাই, ফুটবল মাঠে। তা হলে অন্তত কিছুটা শান্তি পাব।
মাঠে নামলাম, বিশ্বাস করুন, হাঁটু কাঁপছিল। সেদিন বলিনি, আজ বলছি। তবে নিজের ও দলের শক্তির প্রতি বিশ্বাস আর আস্থাটাও তুমুল ছিল। শুধু মেক্সিকো নয়, গোটা পৃথিবী সেদিন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে। খেলা শুরু হতে হাঁটু কাঁপাটাপা উধাও, তখন শুধু গোল চাই আমার। ভালদানো একটা দুর্দান্ত সেন্টার পাঠাল, ডান দিক থেকে। বলটা বাতাসে আসছে, দেখলাম, ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটন গোল ছেড়ে আসছে। আমি কখনও কোনও বলই ছেড়ে দিতাম না, অসম্ভব মনে হলেও একটা শেষ চেষ্টা করতাম। বলতে পারেন, অভ্যাস। হেড করার জন্য লাফালাম, না পেয়ে বাঁ হাত দিয়ে বলটা গোলে পাঠিয়ে দিলাম। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া, ভেবেটেবে করিনি। মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা, শিলটনও বুঝে উঠতে পারেনি। ও আমার চেয়ে অনেক লম্বা, আমার দুজনই লাফিয়েছিলাম, এক সাথে। আমি কী করে বলটা ওর আগে পেয়ে গেলাম, সেটা আমার কাছেই রহস্য, আজও। এটা বলাই যথেষ্ট নয় কি যে, বলটা গোলে গিয়েছিল?
অনেকে বলেছিলেন, আমার বলা উচিত ছিল, গোলটা হাত দিয়ে করা। কেন ভাই, এটা তো রেফারির দেখার কথা, গোলটা দেবেন না বাতিল করবেন? মাঠে তার কাজটা নিশ্চয় আমি করে দিতে পারি না। তা ছাড়া একটা বৈধ গোল যখন বাতিল করেন রেফারি, কেউ কি সেই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন? তা হলে এটাই বা কেন শুধু তার ওপরই ছাড়া থাকবে না। এটুকু বলি,প্রতারণা করিনি। অনেকে যদিও ঠগ বলেছিল। আরে বাবা, রেফারি যখন গোলের বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন, আমি তার সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযোগ করতে যাব কেন?
এটা গোলটা কি আমার অবচেতন মনে ধাক্কা দিয়েছিল? কী জানি! কিন্তু মনে হয়েছিল, আরও গোল চাই। অবশেষে আমার পা থেকেই এলো সেই গোল, যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। হ্যাঁ, নির্বাচিত। মনোনীত নয়। ভোটের ফল ওই গোলটা এক নম্বরে থেকে গেছে, পরে কেউ ছাপিয়ে যাবে কি না জানি না। গেলে আমি অন্তত অখুশি হব না। আরো উজ্জ্বল কীর্তির নবীন নায়ককে সানন্দে বরণ করে নেব।
গোলটার কথা আসি। মাঝ মাঠে বলটা পেয়ে দৌড় শুরু করলাম। পেরিয়ে গেলাম বিয়ার্ডসলে, রিডকে, ড্রিবল করলাম বুচারকে, তারপর ফেনউইক। গোলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি, এগিয়ে আসা শিলটনকেও ডজ করলাম, ও মাটিতে পড়ে গেল, আমি বলটা জালে পাঠালাম। কি বলব, একটা অবিশ্বাস্য গোল, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি সেদিন, সত্যিই গোলটা করেছি?
ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, আমারই দুটি গোলে, সমর্থকরা একেবারে পাগল হয়ে গেল। সমর্থক কি শুধু আর্জেন্টিনায়? ধুস, গোটা বিশ্বেই। সেমিফাইনালে পেলাম, বেলজিয়ামকে, তখন আমরা আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে। সহযোদ্ধাদের কথা না বললে চরম অন্যায় হবে, ওরাই আমাকে তাতিয়ে রেখেছিল। মাঠে বলও দিচ্ছিল একের পর এক। বুরুচাগা অনবদ্য, প্রথম গোলটা তো ওরই পাস থেকে। কুসিওফো আর ভালদানো আমার দ্বিতীয় গোলের রাস্তা গড়ে দিল। আমরা ফাইনালে, সামনে জার্মানি।
আহ ফাইনাল! বিশ্বকাপের। এই সেই আসর, যা পৃথিবীর কোনও খেলার কোনও ইভেন্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়। যে খেলেনি, তাকে বোঝানো অসম্ভব। বলুন তো গোটা বিশ্বের অগণিত মানুষের মধ্যে ক’জন এই সুযোগ পায়? কোটি কোটি লোক আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনার গোটা দেশ গণ প্রার্থনায় মগ্ন। অন্তত এক হাজার ক্যামেরার লেন্স আপনার দিকেই তাক করা। চাপ? ভয়ঙ্কর। কিন্তু অভিজ্ঞতাটাও বিরল, অবর্ণনীয়। আমি জানতাম, জার্মানি খুব কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বি, বিশেষত ফাইনালে। ওদের লড়াই তো চিরকালীন, ইতিহাসই বলছে। যা হয় তাই, খেলার শুরু থেকেই আমার একজন পাহারাদার নিযুক্ত হল- লোথার ম্যাথাউজ। শরীরটা চমৎকার, শক্তসমর্থ্য ছেলে এবং খুব ভাল ফুটবলার। প্রথম গোলটা ব্রাউনের। দ্বিতীয়টা ভালদানোর। কিন্তু ওরা যে জার্মানি। জাতটাই মরার আগে মরে না। সমানে সমানে লড়াইয়ে ফিরে এল দুর্দান্তভাবে, ২-২ করে দিল রুমেনিগে। দুটি গোলই ও শোধ করেছিল। ভাবলাম, সেই অতিরিক্ত সময়, ট্রাইব্রেকার যাবে ম্যাচটা? দুই গোলে এগিয়ে থাকার ফল পাব না?
ভেতর থেকে কেউ বলল, চ্যাম্পিয়ন হতেই হবে। বুরুচাগাকে বলে দিলাম, তুই ওপরে ওঠ। দেখছিস না, ওরা ক্লান্ত। ও দৌড় শুরু করল, ব্যাপারটা দেখেই বলটা পাস করে দিলাম। রক্ষণ ফুঁড়ে বেরিয়ে ৩-২ করে দিল বুরুচাগা। আমাদের গোটা দল তখন ওর ঘাড়ের ওপর আমিও! বড় ধরনের আঘাতও লাগতে পারত। কিন্তু খেলা শেষ হচ্ছে না কেন? রেফারি আর পি ফিলহো তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, আমি তাকিয়ে তার দিকে। উফ্, কখন লম্বা বাঁশিটা বাজবে! বাজল। আমরা বিশ্বজয়ী! আর্জেন্টিনা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে বিশ্বকাপ। গোটা আজটেক স্টেডিয়াম লাফাচ্ছে, কে বলল, ওরা নেহাতই ফুটবলপ্রেমী? সেই মুহূর্তে মানুষগুলোকে মনে হচ্ছিল রণোন্মাদ যোদ্ধা।
আমাকে ক্ষমা করবেন। ফিফা সভাপতি হ্যাভেলাঞ্জ যখন আমার হাতে সোনার কাপটা তুলে দিলেন, সেই মুহূর্তের অনুভূতি এই খেলায় প্রকাশ করার উপযুক্ত শব্দ এই কলমের নেই। কাপটা মাথার ওপর তুলে ধরলাম। এর চেয়ে গর্বের মুহূর্ত সারা জীবনে আসেনি। দেশে ফেরার পর কাসা রোসান্দায় প্রেসিডেন্ট আলফসনসিন রাজকীয় সংবর্ধনা দিলেন। প্রত্যেককে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, আর্জেন্টিনার সম্মান, অহঙ্কার আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। আমি আর একবার কাপটা ওপরে তুলে ধরলাম, অনেক ওপরে। আকাশটাই ছুঁতে চেয়েছিলাম না আমরা?
সূত্র : ইন্টারনেট
বিশ্বকাপের সেই গোলটি নিয়ে কী বলেছিলেন ম্যারাডোনা
ম্যারাডোনার সেই গোল
কখনও কি ভাবতে পেরেছিলাম?
আমি বুয়েনস এয়ার্সের ঘিঞ্জি বস্তির দরিদ্র সন্তান, কোথাকার কে এক দিয়েগো ম্যারাডোনা, বিশ্বকাপ খেলে ফেললাম। এক আধটা নয়, চারটে! শুধু তাই নয়, আরো কত কী ঘটে গেল আমার জীবনে, স্বপ্নের মতো।
যে চারটে বিশ্বকাপ খেলেছি, তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে আছে ১৯৮৬। মেক্সিকো। কারণটা আপনারা জানেন। ২৯ জুন, ১৯৮৬ তারিখটা কী করে ভোলা সম্ভব? আজটেক স্টেডিয়ামে সে দিন আমার হাতেই ধরা ছিল বিশ্বকাপ। উঁচুতে তোলা, যেন আকাশ ছুঁতে চাইছে সে। আমিও। সত্যি? নাকি স্বপ্ন? সংশয়, তর্কের কোনো অবকাশ নেই, ওটা আমার ফুটবল জীবনের চিরশ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। একটা
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আর্জেন্টিনার ভক্তদের। নিজেকেও। বিশ্বকাপটা ফিরিয়ে আনব আর্জেন্টিনায়। প্রতিশ্রুতিটা পালন করতে পেরে নিজেই সম্মানিত বোধ করছিলাম।
১৯৭৮-এ আমরা প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছিলাম। স্কোয়াডে নির্বাচিত হয়েও খেলা হয়নি। কোচ ‘ফ্ল্যাকো’ মেনোত্তি শেষ মুহূর্তে আমাকে বাদ দিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, ছেলেটা বড্ড বাচ্চা। অন্তত বিশ্বকাপের পক্ষে। আমি কি করেছিলাম জানেন? গলা ভেঙে ফেলেছিলাম। প্রথমে কেঁদে। পরে আমাদের দলটার সমর্থনে চিৎকার করে। বিশ্বাস করুন, বাদ পড়ার পর একটা সময় শুধু কেঁদেছি। দিনের পর দিন। রাতের পর রাত।
সেই কান্নার শেষ ১৯৮২-তে, স্পেনে। অবশেষে বিশ্বকাপ খেলল আপনাদের এই দিয়েগো। কিন্তু ওটা একটা দুঃস্বপ্ন, আজও। যাদের কাছে হেরে গেলাম, সেই ইটালিই সেবার বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন। ওই ম্যাচটাও কখনও ভুলব না। আমাকে ভয়ঙ্কর কড়া পাহারায় রেখেছিল ক্লডিও জেন্তিলে। কিন্তু এর নাম পাহারা? আমাকে থামাতে সেদিন কি করেনি? বিচ্ছিরি সব ফাউল। মারের পর মার। এমনকি জার্সিও
ছিঁড়ে দিয়েছিল। তারপর ব্রাজিল ম্যাচে লাল কার্ড দেখলাম। অপেক্ষায় ছিলাম চারটে বছর, তাকিয়ে ছিলাম ১৯৮৬-র দিকে, বদলা নেয়ার জন্য। আমার মাথায় তখন প্রতিশোধের আগুন।
১৯৮৬-র বিশ্বকাপ সবদিক থেকেই স্মরণীয়। কোচ কার্লোস বিলার্দো, যিনি ‘বিগ নোজ’ নামে পরিচিত, আমাকে নেতৃত্ব দিতে বললেন। কবে প্রস্তাবটা এলো? ১৯৮৩-তে, বিশ্বকাপের তিন বছর আগেই! আমি, কী বলব, রোমাঞ্চিত। আলোড়িত। অভিভূত। হাতে অফুরন্ত সময়, রণকৌশল, পরিকল্পনা ছকে নেয়ার জন্য। ইটালির লিগে নাপোলিতে তখন চুটিয়ে খেলছি, বিশ্বকাপের ঠিক আগে ওদের হয়ে দ্বিতীয় মৌসুমটা শেষ করলাম। নেপোলি সেবার তিন নম্বরে থাকল, আমি এগারো গোল করলাম। ক্লাব দলের উন্নতিতে খুশি ছিলাম, কিন্তু আমার চোখে যে তখন বিশ্বজয়ের রঙিন স্বপ্ন বারবার হানা দিচ্ছে। সতীর্থদের সাথে মানিয়ে নিতে, নিজেকে আরো তৈরি ও ধারালো করতে ফিরে এলাম দেশে।
সেবারের দলটায় আমার কত বন্ধু ছিল! বাতিস্তা, বুরুচাগা, গিউস্তি, ওলার্তেকোচিয়া, ভালদানো, রুগেরি, ব্রাউন, কুসিওফো, এনরিক। আমার তখন একটা সংঘবদ্ধ, ঐক্যবদ্ধ দল। ঝগড়া নেই, সঙ্ঘাত নেই, ব্যক্তিগত লড়াই নেই, একেবারে সুখি পরিবার। সবচেয়ে বড় কথা, আমাদের মধ্যে প্রতিশোধের নেশা ছিল, ঔদ্ধত্য ছিল না। আত্মবিশ্বাস ছিল, অহঙ্কার ছিল না। এটা, আমি
বিশ্বাস করি, একটা দলকে সাফল্যের ঝলমলে চূড়াটায় তোলার জন্য খুব জরুরি।
মেক্সিকোয় পৌঁছে আমাদের ঘাঁটি ছিল পুয়েবলোয়। গ্রুপে কোরিয়াকে হারালাম। ইটালির সাথে বদলাটা সেভাবে নেয়া গেল না, ১-১। বুলগেরিয়াকে মারলাম, ২-০। তবে ইটালি ম্যাচ একটা অন্য তৃপ্তি দিয়ে গেল। ওদের গোলরক্ষক গেলির বিরুদ্ধে করলাম আমার জীবনের অন্যতম প্রিয় গোল। আর্জেন্টিনা ভাল খেলছিল। টেকনিক অবশ্যই দরকার, ওটা তো ছিলই, আর ছিল প্রবল ইচ্ছাশক্তি। কাপ জয়ের জন্য জান বাজি রাখার অঙ্গীকার। উরুগুয়েকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছলাম, সামনে ইংল্যান্ড।
ইংল্যান্ড! সেই ইংল্যান্ড! আর কি শুধুই ফুটবল ম্যাচ থাকে ওটা! ওই খেলা হয়ে উঠল যুদ্ধ। বহু আগে আমাদের কিছু স্বৈরতন্ত্রী একটা যুদ্ধ শুরু করেছিলেন-ফকল্যান্ড! ইতিহাস তো মিথ্যা হতে পারে না, আমাদের চরম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। কত অসংখ্য আর্জেন্টিনীয়কে যে হত্যা করেছিল ওই বর্বর ইংরেজরা! ওদের তাই কোনও দিন ক্ষমা করতে পারিনি, সারা জীবনে পারব না। আমাদের দেশবাসীরও কাতর আবেদন ছিল, এবার বদলা চাই, ফুটবল মাঠে। তা হলে অন্তত কিছুটা শান্তি পাব।
মাঠে নামলাম, বিশ্বাস করুন, হাঁটু কাঁপছিল। সেদিন বলিনি, আজ বলছি। তবে নিজের ও দলের শক্তির প্রতি বিশ্বাস আর আস্থাটাও তুমুল ছিল। শুধু মেক্সিকো নয়, গোটা পৃথিবী সেদিন রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় থরথর করে কেঁপেছে। খেলা শুরু হতে হাঁটু কাঁপাটাপা উধাও, তখন শুধু গোল চাই আমার। ভালদানো একটা দুর্দান্ত সেন্টার পাঠাল, ডান দিক থেকে। বলটা বাতাসে আসছে, দেখলাম, ইংল্যান্ডের গোলরক্ষক পিটার শিলটন গোল ছেড়ে আসছে। আমি কখনও কোনও বলই ছেড়ে দিতাম না, অসম্ভব মনে হলেও একটা শেষ চেষ্টা করতাম। বলতে পারেন, অভ্যাস। হেড করার জন্য লাফালাম, না পেয়ে বাঁ হাত দিয়ে বলটা গোলে পাঠিয়ে দিলাম। স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া, ভেবেটেবে করিনি। মুহূর্তে ঘটে গেল ঘটনাটা, শিলটনও বুঝে উঠতে পারেনি। ও আমার চেয়ে অনেক লম্বা, আমার দুজনই লাফিয়েছিলাম, এক সাথে। আমি কী করে বলটা ওর আগে পেয়ে গেলাম, সেটা আমার কাছেই রহস্য, আজও। এটা বলাই যথেষ্ট নয় কি যে, বলটা গোলে গিয়েছিল?
অনেকে বলেছিলেন, আমার বলা উচিত ছিল, গোলটা হাত দিয়ে করা। কেন ভাই, এটা তো রেফারির দেখার কথা, গোলটা দেবেন না বাতিল করবেন? মাঠে তার কাজটা নিশ্চয় আমি করে দিতে পারি না। তা ছাড়া একটা বৈধ গোল যখন বাতিল করেন রেফারি, কেউ কি সেই সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন? তা হলে এটাই বা কেন শুধু তার ওপরই ছাড়া থাকবে না। এটুকু বলি,প্রতারণা করিনি। অনেকে যদিও ঠগ বলেছিল। আরে বাবা, রেফারি যখন গোলের বাঁশি বাজিয়ে দিয়েছেন, আমি তার সিদ্ধান্ত নিয়ে অভিযোগ করতে যাব কেন?
এটা গোলটা কি আমার অবচেতন মনে ধাক্কা দিয়েছিল? কী জানি! কিন্তু মনে হয়েছিল, আরও গোল চাই। অবশেষে আমার পা থেকেই এলো সেই গোল, যা বিশ্বকাপের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা গোল হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। হ্যাঁ, নির্বাচিত। মনোনীত নয়। ভোটের ফল ওই গোলটা এক নম্বরে থেকে গেছে, পরে কেউ ছাপিয়ে যাবে কি না জানি না। গেলে আমি অন্তত অখুশি হব না। আরো উজ্জ্বল কীর্তির নবীন নায়ককে সানন্দে বরণ করে নেব।
গোলটার কথা আসি। মাঝ মাঠে বলটা পেয়ে দৌড় শুরু করলাম। পেরিয়ে গেলাম বিয়ার্ডসলে, রিডকে, ড্রিবল করলাম বুচারকে, তারপর ফেনউইক। গোলের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছি, এগিয়ে আসা শিলটনকেও ডজ করলাম, ও মাটিতে পড়ে গেল, আমি বলটা জালে পাঠালাম। কি বলব, একটা অবিশ্বাস্য গোল, আমার নিজেরই বিশ্বাস হয়নি সেদিন, সত্যিই গোলটা করেছি?
ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের বাইরে পাঠিয়ে দিলাম, আমারই দুটি গোলে, সমর্থকরা একেবারে পাগল হয়ে গেল। সমর্থক কি শুধু আর্জেন্টিনায়? ধুস, গোটা বিশ্বেই। সেমিফাইনালে পেলাম, বেলজিয়ামকে, তখন আমরা আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে। সহযোদ্ধাদের কথা না বললে চরম অন্যায় হবে, ওরাই আমাকে তাতিয়ে রেখেছিল। মাঠে বলও দিচ্ছিল একের পর এক। বুরুচাগা অনবদ্য, প্রথম গোলটা তো ওরই পাস থেকে। কুসিওফো আর ভালদানো আমার দ্বিতীয় গোলের রাস্তা গড়ে দিল। আমরা ফাইনালে, সামনে জার্মানি।
আহ ফাইনাল! বিশ্বকাপের। এই সেই আসর, যা পৃথিবীর কোনও খেলার কোনও ইভেন্টের সঙ্গে তুলনীয় নয়। যে খেলেনি, তাকে বোঝানো অসম্ভব। বলুন তো গোটা বিশ্বের অগণিত মানুষের মধ্যে ক’জন এই সুযোগ পায়? কোটি কোটি লোক আপনার দিকে তাকিয়ে আছে। আপনার গোটা দেশ গণ প্রার্থনায় মগ্ন। অন্তত এক হাজার ক্যামেরার লেন্স আপনার দিকেই তাক করা। চাপ? ভয়ঙ্কর। কিন্তু অভিজ্ঞতাটাও বিরল, অবর্ণনীয়। আমি জানতাম, জার্মানি খুব কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বি, বিশেষত ফাইনালে। ওদের লড়াই তো চিরকালীন, ইতিহাসই বলছে। যা হয় তাই, খেলার শুরু থেকেই আমার একজন পাহারাদার নিযুক্ত হল- লোথার ম্যাথাউজ। শরীরটা চমৎকার, শক্তসমর্থ্য ছেলে এবং খুব ভাল ফুটবলার। প্রথম গোলটা ব্রাউনের। দ্বিতীয়টা ভালদানোর। কিন্তু ওরা যে জার্মানি। জাতটাই মরার আগে মরে না। সমানে সমানে লড়াইয়ে ফিরে এল দুর্দান্তভাবে, ২-২ করে দিল রুমেনিগে। দুটি গোলই ও শোধ করেছিল। ভাবলাম, সেই অতিরিক্ত সময়, ট্রাইব্রেকার যাবে ম্যাচটা? দুই গোলে এগিয়ে থাকার ফল পাব না?
ভেতর থেকে কেউ বলল, চ্যাম্পিয়ন হতেই হবে। বুরুচাগাকে বলে দিলাম, তুই ওপরে ওঠ। দেখছিস না, ওরা ক্লান্ত। ও দৌড় শুরু করল, ব্যাপারটা দেখেই বলটা পাস করে দিলাম। রক্ষণ ফুঁড়ে বেরিয়ে ৩-২ করে দিল বুরুচাগা। আমাদের গোটা দল তখন ওর ঘাড়ের ওপর আমিও! বড় ধরনের আঘাতও লাগতে পারত। কিন্তু খেলা শেষ হচ্ছে না কেন? রেফারি আর পি ফিলহো তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, আমি তাকিয়ে তার দিকে। উফ্, কখন লম্বা বাঁশিটা বাজবে! বাজল। আমরা বিশ্বজয়ী! আর্জেন্টিনা ফিরিয়ে আনতে পেরেছে বিশ্বকাপ। গোটা আজটেক স্টেডিয়াম লাফাচ্ছে, কে বলল, ওরা নেহাতই ফুটবলপ্রেমী? সেই মুহূর্তে মানুষগুলোকে মনে হচ্ছিল রণোন্মাদ যোদ্ধা।
আমাকে ক্ষমা করবেন। ফিফা সভাপতি হ্যাভেলাঞ্জ যখন আমার হাতে সোনার কাপটা তুলে দিলেন, সেই মুহূর্তের অনুভূতি এই খেলায় প্রকাশ করার উপযুক্ত শব্দ এই কলমের নেই। কাপটা মাথার ওপর তুলে ধরলাম। এর চেয়ে গর্বের মুহূর্ত সারা জীবনে আসেনি। দেশে ফেরার পর কাসা রোসান্দায় প্রেসিডেন্ট আলফসনসিন রাজকীয় সংবর্ধনা দিলেন। প্রত্যেককে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, আর্জেন্টিনার সম্মান, অহঙ্কার আমরা ফিরিয়ে আনতে পেরেছি। আমি আর একবার কাপটা ওপরে তুলে ধরলাম, অনেক ওপরে। আকাশটাই ছুঁতে চেয়েছিলাম না আমরা?
সূত্র : ইন্টারনেট