মধ্যপ্রাচ্য
ট্রাম্পের ঘোষণা : কী করবে ইরান!
অবশেষে ইরানের সঙ্গে করা পরমাণু চুক্তি জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) থেকে সরে গেল যুক্তরাষ্ট্র। গত মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি চুক্তির ত্রুটিগুলো উল্লেখ করে কঠোর ভাষায় এর সমালোচনা করেন। পূর্বসূরি ওবামা আমলে স্বারিত এই চুক্তিকে ‘য়িষ্ণু ও পচনশীল’ আখ্যা দেন তিনি। তবে তিনি নিজে এর কোনো বিকল্প উল্লেখ করেননি।
ট্রাম্পের এ পদক্ষেপের কারণে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ওয়াশিংটনের। এক মাস যাবৎ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বিশেষ করে চুক্তির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা ট্রাম্পকে এ পদক্ষেপ নেয়ার আগে ভালোভাবে বিবেচনার অনুরোধ করেন। কিন্তু ট্রাম্প তার আগের মতেই অটল থাকেন। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে তার যুদ্ধ আবার নতুন করে শুরু হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ট্রাম্পের এই ঘোষণার ফলে চুক্তিটি একেবারেই শেষ হয়ে যায়নি। বিশেষ করে অন্য রাষ্ট্রগুলো যখন এ ইস্যুতে ইরানের সাথে আছে। কয়েকটি দেশ ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে তারা ইরানের সাথে আছে। তারপরও যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় এ চুক্তি অনেকটাই বিপন্ন হয়ে পড়েছে। তবে চুক্তির ভবিষ্যৎ পুরোপুরি নির্ভর করছে ইরানের প্রতিক্রিয়ার ওপর।
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি এ চুক্তির একজন একনিষ্ঠ সমর্থক। তিনি সম্ভাব্য সব প্রক্রিয়ায় এ চুক্তিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাইবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের ভেতর থেকেই তিনি বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। বিরোধীদের দাবি, শুধু এই চুক্তি নয়, বরং এনটিপির মতো পরমাণু অস্ত্র বিস্তার বিরোধী চুক্তি থেকে ইরানের সরে আসা উচিত। ইরানের প্রেসিডেন্ট বলেন, তারা কয়েক সপ্তাহ অপো করবেন এবং এ চুক্তির পে যেসব মিত্র দেশ আছে, তাদের সাথে কথা বলবেন। সব কিছু ইরানের জাতীয় স্বার্থের ওপর নির্ভর করবে বলে রুহানি উল্লেখ করেন।
ত্রুটিপূর্ণ চুক্তি কিন্তু কার্যকর
বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরমাণু কর্মসূচির কথা বলে তেহরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে বলে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল পশ্চিমাদের। বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছরের উত্তেজনার সমাপ্তি ঘটে ২০১৫ সালে জেসিপিওএ চুক্তির মাধ্যমে। সে সময় ইরান বিশ্বের ছয়টি পরাশক্তির সাথে তার পরমাণু কর্মসূচি সংক্রান্ত একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে আসতে সম্মত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি, অর্থাৎ পি ফাইভ প্লাস ওয়ান নামে পরিচিত পরাশক্তিগুলো ছিল এই চুক্তির অংশীদার। অনেক আলোচনা-সমালোচনা হলেও এ চুক্তিটির কারণে ইরানের পরমাণু কার্যক্রম অনেকটাই মন্থর হয়ে আসে। এ চুক্তির ফলে দেশটির ওপর আরোপ করা অর্থনৈতিক অবরোধের অবসান ঘটে। বিশেষ করে তেল রফতানি, বাণিজ্য ও ইরানের ব্যাংকিং খাতের ওপর আরোপ করা অবরোধ তুলে নেয়া হয়েছিল। শুরু থেকেই নানা বিতর্কের মুখে পড়ে এ চুক্তিটি। অনেকেই মনে করতেন, এ চুক্তি রক্ষায় এটি ছাড়া আর কোনো যৌক্তিক কারণ নেই যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ চুক্তিটি করেছেন। কারণ হিসেবে তারা মনে করেন, ইরানের বিতর্কিত ও আগ্রাসী পরমাণু উচ্চাভিলাষ রোধ করা গেলেও চুক্তিটি ইরানের পরমাণু বিষয়ক সব কার্যক্রম যেমন ক্ষেপণাস্ত্র প্রোগ্রাম বা আঞ্চলিক ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। তবে যাই হোক না কেন, চুক্তিটি কিন্তু কাজ করছিল। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য রাষ্ট্রগুলোও মনে করে, ইরান চুক্তির শর্তগুলো পুরোপুরি মেনে চলছিল।
সামনে কঠিন সময়
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করার ঘোষণা দেয়ার পর ইউরোপের প থেকে ুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে। তারা এ চুক্তির ক্ষেত্রে ইরানের পাশে থাকার কথা ঘোষণা দিয়েছেন। একই সাথে তারা চুক্তির শর্তগুলো বজায় রাখার জন্য ইরানকেও আহবান জানান। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারটিও অন্যদের চিন্তায় ফেলছে। নতুন নিষেধাজ্ঞায় তেহরানের শিল্প খাত, তেল, এয়ারক্রাফট রফতানি খাত ও মূল্যবান ধাতু বাণিজ্যকে ল্য বানানো হবে। মার্কিন ডলার কিনতে ইরান সরকারের চেষ্টা যেন ব্যাহত হয় সে চেষ্টাও করা হবে। মার্কিন গণমাধ্যমগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের বরাত দিয়ে বলা হয়, ইরানের সঙ্গে ব্যবসা গোটাতে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোকে ছয় মাসের সময় দেয়া হয়েছে। না হলে ওই কোম্পানিগুলোকেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হবে বলেও সতর্ক করেন তিনি।
কী করবে ইরান
ইরান এ ক্ষেত্রে কী করবে এখন এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ইরান এ ক্ষেত্রে প্রথমে বিষয়টি নিয়ে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ঘোষণা দিয়েছেন, চুক্তি বহাল রাখতে ওয়াশিংটনকে বাদ দিয়েই স্বারকারী ইউরোপীয় পাঁচ দেশের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাবে তার দেশ। আলোচনায় সমঝোতা হলে চুক্তি বহাল থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তবে যদি তাতেও এর কোনো সমাধান না আসে তাহলে সে ক্ষেত্রে ইরান জাতিসঙ্ঘে যেতে পারে। তবে সেটি ইরানের জন্য খুব একটা সুবিধাজনক হবে না, কারণ যুক্তরাষ্ট্র সে ক্ষেত্রে শুধু ভেটো দেয়াই নয়, বরং তার নিজের দেয়া অঙ্গীকার থেকেও সরে আসতে পারে। ফলে ইরানের জন্য তা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ইরান যা করতে পারে, তা হলো তারা আবারো পরমাণু কার্যক্রম শুরু করার ঘোষণা দিতে পারে। যেমনটি ইতোমধ্যেই হাসান রুহানি করেছেন।
তিনি দেশটির অ্যাটমিক এনার্জি অর্গানাইজেশন অব ইরানকে (এইওআই) নতুন করে কোনো সীমারেখাহীন পরমাণু সমৃদ্ধকরণের জন্য প্রস্তুত হতে নির্দেশ দিয়েছেন। তবে এ পদক্ষেপ নিলে যেহেতু ইউরোপের সাথে দেশটির সব অর্থনৈতিক কার্যক্রম বাধার মুখে পড়বে, তাই ইরান সহসাই বিশেষ করে প্রথম পর্যায়ে অন্তত এ কাজ করবে না।
এ ছাড়া চুক্তি অনুযায়ী দেশটিতে জাতিসঙ্ঘের পরমাণু বিষয়ক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি বা আইএইএ’র পরিদর্শকরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং সামরিক প্রকল্পগুলো পরিদর্শন করতে পারবেনÑ সে ব্যাপারে সম্মতি দেয় তেহরান। সে ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে তারা। এ ছাড়া তেহরান তাদের ব্যালেস্টিক মিসাইল পরীক্ষার হার বাড়িয়ে দিতে পারে।