এপ্রিলের আবহাওয়া এমন বদলে গেল কেন?

এপ্রিলের আবহাওয়া এমন বদলে গেল কেন?
বজ্রবৃষ্টি
কয়েক বছর ধরে এপ্রিলের আবহাওয়ার সঙ্গে যেন তাল মেলানো যাচ্ছে না। দুই বছর আগেও যে মাসে গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা ছিল, এবার এখনো তেমন গরম টের পাওয়া যাচ্ছে না।

বরং বছরের অন্যতম উষ্ণ মাসটি হঠাৎ পরিণত বৃষ্টিমুখর হয়ে গেছে। বৃষ্টির কারণে গড় তাপমাত্রা কমে এসেছে। পুরো মাসে এক দিন ছাড়া সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করেছে। এমনকি সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেও নেমে এসেছিল।

সব মিলিয়ে ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিন’ যেন আগেভাগে এই এপ্রিলেই চলে এসেছে।

এপ্রিলে কেন আবহাওয়ার এই আচরণ? 
বিশেজ্ঞরা বলছেন, প্রকৃতির এই আচরণ স্বাভাবিক, নাকি অস্বাভাবিক, তা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তাই বায়ুর আর্দ্রতার তারতম্যের রেখার পর মেঘমালা প্রচুর পরিমাণে তৈরি হচ্ছে। এ কারণে এপ্রিল মাসে দেশের উত্তর থেকে পূর্বাঞ্চলে কালবৈশাখীর সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টি বেশি হতে দেখা গেছে। এই ধারাবাহিকতা মে মাসেও থাকতে পারে।

কমেছে তাপমাত্রা
চার বছর আগের ঘটনা। তারিখটা ছিল ২০১৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বাংলা বর্ষপঞ্জির অনুসারে দিনটি ছিল ১২ বৈশাখ। ওই দিন যেন বাংলার বৈশাখ আর ইংরেজির এপ্রিল মাস তার নামের মর্যাদা ধরে রাখার চেষ্টা করছিল। কারণ, আকাশে ছিল না মেঘের ছিটেফোঁটা। সূর্য টগবগ করে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল। সূর্যতাপ এতটাই ছিল যে, সেদিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠে যায় যশোরে ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল এপ্রিলে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। একই দিন রাজধানী ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তর ১৯৪১ সাল থেকে তাপমাত্রার হিসাব করে আসছে। তাদের এই হিসাবের খাতা থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের ১৮ মে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায় তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা এর চেয়ে বেশি থাকার রেকর্ড আবহাওয়া অধিদপ্তরের কাছে নেই। 
চার বছর পর এ বছরের ২৫ এপ্রিল দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয় রাঙামাটিতে ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই দিন রাজধানী ঢাকায় ৩৪ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং যশোর জেলায় ৩৫ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল।

এপ্রিলে গত চার বছরে বৃষ্টিপাত
এপ্রিলের গরমের এই হিসাব যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। বাংলাদেশের গরমে হাঁসফাঁস এপ্রিলে গরম কম অনুভূত হয়েছে। এই মাসটি দুই বছর ধরে হয়ে গেছে বৃষ্টিমুখর। এপ্রিলে বৃষ্টির ধারা স্বাভাবিকের মাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। গত ৩০ বছরের গড় হিসাবে এ মাসে বাংলাদেশে স্বাভাবিক বৃষ্টি হয় ১২৭ মিলিমিটার। কিন্তু এ বছর বৃষ্টি হয়েছে ১৭৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার। এটি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। ২০১৭ সালের এপ্রিলে বৃষ্টি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে ১০৬ দশমিক ২ শতাংশ বেশি।

এর আগে ২০১৫ সালের এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃষ্টি কম হয়েছিল। ২০১৬ সালের এপ্রিলে ৫০ দশমিক ৭ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল।

৩০ দিনের মাস এপ্রিল। এই মাসের ২৮টি দিনই এবার দেশের কোনো না কোনো এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে কালবৈশাখী, বজ্রপাত আর শিলাবৃষ্টি তো ছিলই। তাই যেন বৃষ্টির দাপটে গরমও কাবু হয়ে যায় এপ্রিলে। এক দিন ছাড়া সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪ থেকে ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যেই ছিল। শুধু এক দিন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস উঠেছিল ২৭ এপ্রিল ফেনী জেলায়। আবহাওয়া অধিদপ্তর তিনটি দাবদাহ বয়ে যাওয়ার পূর্বাভাস দিলেও তা হয়নি।

এ তো গেল বৃষ্টি আর গরমের হিসাব। কিন্তু কালবৈশাখীর সঙ্গে বজ্রঝড়ও দাপট দেখিয়েছে এপ্রিল মাসজুড়ে। সকাল গড়িয়ে দুপুর আসতে না আসতেই ঘনকালো মেঘ জমে নামে বিজলি চমকানো ঝোড়ো বৃষ্টি। এমনকি মধ্যরাতে মেঘের সঙ্গে মেঘের সংঘর্ষ ঘটিয়ে আকাশ গর্জন করে বিজলির চমক দেখা গেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই বজ্রবৃষ্টির কারণে এপ্রিল মাসে সারা দেশে মারা যায় ৫৮ জন।

ঝড়-বৃষ্টি বেশি হওয়ার কারণ সম্পর্কে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, পশ্চিমা লঘুচাপের সঙ্গে পুবালি বায়ুপ্রবাহের সংযোগ এবং বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে জলীয় বাষ্পের জোগান বৃদ্ধির কারণে প্রথম দফায় ৫ থেকে ১২ এপ্রিল পর্যন্ত বিজলি চমকিয়ে ঝোড়ো বৃষ্টি হয়। এরপর এমনভাবে বিজলি চমকিয়ে ঝোড়ো বৃষ্টি হয়েছে দ্বিতীয় দফায় ১৭ থেকে ২২ এপ্রিল ছয় দিন, তৃতীয় দফায় ২৪ থেকে ২৬ এপ্রিল তিন দিন এবং সর্বশেষ চতুর্থ দফায় ২৮ থেকে ৩০ এপ্রিল।

ঝড়-বৃষ্টিতে এপ্রিল মাসের চরিত্র বদলাতে বিস্মিত আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা। তবে এটি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘটছে কিনা সে ব্যাপারে এখনই তাঁরা মন্তব্য করতে চান না। তাঁদের মতে, এই বিষয়ে দীর্ঘ সময় গবেষণার প্রয়োজন।

আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক প্রথম আলোকে বলেন, পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত জলীয় বাষ্পের জোগান অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর কম ছিল। এর সঙ্গে ঊর্ধ্ব স্তরেও জলীয় বাষ্পের আধিক্য কম ছিল। কিন্তু মধ্যাঞ্চলের পূর্ব দিকে আবার জলীয় বাষ্পের পরিসর বেশি থাকছে। তাই বায়ুর আর্দ্রতার তারতম্যের রেখার পর মেঘমালা প্রচুর পরিমাণে তৈরি হচ্ছে। এ কারণে দেশের উত্তর থেকে পূর্বাঞ্চলে কালবৈশাখীর সঙ্গে বজ্রসহ বৃষ্টি বেশি হতে দেখা গেছে।

মেঘের বিস্তৃতিও বেশি থাকায় তাপমাত্রা বেশ কম ছিল বলে উল্লেখ করেন এই আবহাওয়াবিদ। তিনি বলেন, এবার এপ্রিলে সকালের পরপরই দুপুরের দিকে কালবৈশাখী বয়ে গেছে। কিন্তু এই গ্রীষ্মকালে দুপুরের দিকে সূর্যের তেজ বেশি থাকে। কালবৈশাখীর কারণে সূর্য কিরণ ছড়াতে না পারায় তাপমাত্রা বৃদ্ধিও পায়নি। এ ছাড়া বাতাসে জলীয় বাষ্পও কম ছিল। এ জন্য মানুষের মধ্যে অস্বস্তি বোধও কম হয়েছে।